কিছু কথা

in instablurt •  3 years ago 

এমন অভাবনীয় খুশির বার্তাটি যেদিন পাই সেদিন প্রথমেই মার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। মাকে সালাম করে দাঁড়াতেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, নিশ্চয়ই কোন খুশির খবর আছে বেটা। বল না কি সে খুশির খবরটা?

খুশিতে সত্যিই তখন আমার চোখ চিকচিক করছে। মায়ের দিকে দৃষ্টি তুলে বললাম, আমি কাশ্মীর সফরের দাওয়াত পেয়েছি। কেন্দ্রীয় অফিস আমার সফরের সব ব্যবস্থা করছে। তারা চাচ্ছে আমাকে দিয়ে কাশ্মীরের রণাঙ্গনের উপর একটা স্পেশাল স্পট স্টোরি করাতে। আমার সফরের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন ছাড়াও বেতন বাদে সফর শেষে পাব বার হাজার সৌদি রিয়াল । এবার তুমিই বল খবরটা সত্যিই খুশির কি না?

মা আমার মুখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। চাকরি পাওয়ার খবর শুনে মা প্রথমে যেমন খুশি হয়েছিলেন, ভেবেছিলাম তেমনি খুশি হবেন আজও। কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তেমনটা আমার মনে হয়নি। তাই জিজ্ঞেস করলাম, তুমি খুশি হওনি আম্মা?

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, সন্তানের সাফল্যে পিতা-মাতার চেয়ে বেশি খুশি আর কে হতে পারে। কিন্তু আমি ভাবছি...

: থামলে কেন আম্মা, কি ভাবছো তুমি? : ভাবছি, কাশ্মীরের মতো গোলযোগপূর্ণ জায়গায় আমার একমাত্র ছেলেকে
পাঠিয়ে দিয়ে এ মনকে প্রবোধ দেবো কি করে?

এবার মায়ের আশংকার কারণটা খুঁজে পেলাম। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, মাত্র তো কটা দিন। এতেই তুমি এমন বেকারার হয়ে পড়লে চলবে কেন মা। একবার কি ভেবে দেখেছো, তোমার মতো হাজার হাজার মায়ের সন্তান সেখানে আজাদীর জন্য দুশমনের বুলেটের সামনে বুক পেতে লড়াই করে। চলেছে বছরের পর বছর। আমি তো সেখানে লড়াই করতে যাচ্ছি না, যাচ্ছি সংবাদ সংগ্রহের জন্য ।

মা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, যখন সন্তানের পিতা হবে তখন বুঝবে আমার দুঃখ-দুশ্চিন্তার উৎসটা কোথায়। মায়ের বেদনাক্লিষ্ট মুখের দিকে চেয়ে আর কথা বাড়াতে পারিনি। কতক্ষণ নীরব থেকে নিজের ঘরে চলে যাই।

ছেলেবেলায় বাবাকে হারানোর পর দুঃখিনী মা আমার তিল তিল করে অতি যত্নে আমাকে এতটুকু বড় করেছেন। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর প্রতি সপ্তাহে মায়ের একটি চিঠি পেতাম। আমাকেও লিখতে হতো সমান তালে। কত কষ্টে কেটেছে প্রথম বছরটি। যখনই গ্রামের বাড়ি থেকে আসা মানি অর্ডারটা আমার হাতে পড়ত, তখনই বুঝতাম ঢাকা শহরের হিসেবে সামান্য এ ক’টি টাকা পাঠাতে মাকে কত গলদঘর্ম হতে হয়েছে। তারপর দু'তিনটা টিউশনি জুটিয়ে মায়ের কষ্টটা অনেকটাই লাঘব করেছিলাম। অনার্স শেষ করার পর দেশীয় ক’টি সংবাদপত্রে টুকটাক লিখেও কিছু পেতাম। তারপর সৌভাগ্যবশতই Islamic Broadcasting Agency (IBA)-তে চাকরিটা পেয়ে যাই। সংস্থাটি তখন কেবল তাদের যাত্রা শুরু করেছে। তারা নিজেদের একটি Weekly প্রকাশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে আহরিত সংবাদ বিক্রি করে থাকে। বিজ্ঞাপনটি পেয়েছিলাম দি মুসলিম ওয়ার্ল্ডলীগ জার্নালে । যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর এপ্লাই করে ইন্টারভিউয়ে ফার্স্ট হয়ে চাকরিটা পেয়ে যাই। পড়াশোনার সময় কিছুটা সংকুচিত হয়ে এলেও চাকরিটার বড়ই প্রয়োজন ছিল আমার। বাংলাদেশী মুদ্রায় হাজার দশেক টাকা দিয়ে শুরু হয়েছিল। দু'বছরের মধ্যেই বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তাই ফাইনাল পরীক্ষার আগেই দু'রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে মাকে নিয়ে আসি ঢাকায়। মাস্টার্স ফাইনাল শেষ হয়েছে কেবল। এর মধ্যে কোম্পানীর কাশ্মীর সফরের অফারটা আমাকে দারুণ আনন্দ দেয়। কিন্তু মা যে আমার কি! ছেলে বড় হয়েছে, এখনো কি ঘরে বসে থাকবে নাকি? আমি নিশ্চিত, মা যদি আগে জানতেন সংবাদপত্র জগতের মানুষদের এভাবে

ছোটাছুটি করতে হয়, তাহলে জার্নালিজমে পড়তেই দিতেন না। তবে আশার

কথা হলো, মা আজ পর্যন্ত আমার ইচ্ছায় বাধা হয়ে দাঁড়াননি। শেষ পর্যন্ত কাশ্মীর সফরেও বাধা দেবেন না। শুধু মৃদু আপত্তি ছাড়া । চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম কথাগুলো। হঠাৎ মায়ের স্পর্শে চোখ মেলে চাইলাম। দেখি আমার পেছনেই তিনি দাঁড়িয়ে। আমি কিছু বলার আগেই আম্মা বললেন, তা কবে যাচ্ছিস, কিছু ঠিক করেছিস?

: তারিখ তো ওরাই দিয়ে দিয়েছে। হাতে দশ-বার দিন সময় আছে। এ

ক'দিনে কাগজপত্র সব গোছাতে হবে।

ব্যথাহত বিষণ্ন বদন মার। চোখ দুটি সজল হয়ে উঠেছে। আমি একটা কথা ভেবে পাচ্ছি না, তোদের এজেন্সির পাকিস্তানী প্রতিনিধিকে বাদ দিয়ে এ কাজের জন্য তোকে কেন নির্বাচন করলো? সেখানে তাদের ব্যুরো অফিস আছে ...

: এটা আমার সৌভাগ্যই আম্মা। আসলে, সম্ভবত ওরা চাইছে একজন বিদেশীকে দিয়ে কাজটি করা হলে বস্তুনিষ্ঠতা প্রশ্নাতীত হবে এবং সর্বত্রই তা গৃহীত হবে। এজন্যই হয়তো তারা আমাকে নির্বাচন করে থাকবে। আম্মা আমার যুক্তি শুনে এ ব্যাপারে আর কিছু বলেননি। চলে যাবার সময়

বললেন, তাহলে রুকোকে খবরটা জানিয়ে দিস।

আজই আপাকে টেলিফোন করবো। আমি চলে যাবার পর তুমি ইচ্ছে করলে

তাদের ওখানে অথবা বাড়িতে গিয়েও বেড়িয়ে আসতে পারো।

: তারা আগে আসুক । তোকে এক সাথে এয়ারপোর্টে গিয়ে তুলে দিয়ে আসবো। তারপর আমি চিন্তা করে দেখবো কোথায় থাকা যায়। বলে আম্মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

রুকো মানে আমার বড় বোন রুকাইয়া আপাকে টেলিফোন করাসহ দিনের কাজগুলো গুছিয়ে নেবার চেষ্টায় লেগে গেলাম।

বাঙালি মায়েরা সন্তানদের তাদের আঁচলের ছায়াতলে রাখতেই বেশি পছন্দ করে। তাই সন্তানরাও দেহে বড় হলেও মনের দিক থেকে বড় হতে পারে না। ফলে ঘরকুনো থেকে যায় সারাজীবন। এখন এর ব্যতিক্রম কিছুটা ঘটছে অনেকেই হয়তো ঘর থেকে শুধু দুই পা ফেলিয়া' বিশ্বের দু'এক

কাশ্মীরের কান্না ও

জায়গায় ছিটকে পড়ে। তবে তারা পাহাড় শৃঙ্গ অতিক্রম করে সাগরের তলদেশের রহস্য উদঘাটন করতেও নয়, অথবা পাথর হয়ে আকাশে উড়ে উড়ে গ্রহ-নক্ষত্রের তত্ত্ব তালাশের জন্যও নেহায়েতই পেটের দায়ে দেশ ছাড়ে। গায়ের শ্রমের বিনিমে জীবিকানির্বাহ করে, চিন্তার ফসল দিয়ে দেশ-জাতিকে এগিয়ে নেবার ফু কই তাদের? তাই তো বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ যেখানে, সেখানকার মানুষ শুধু নাগাল পায় না। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এসে সাদা চামড়া তা আবিষ্কার করে । তাই সারা জীবন দেখে আসা ঘরের ‘পরে উঁচু টিপটির নাম হয়ে যায় এভারেস্ট শৃঙ্গ।

বিমানে বসে এ কথাটিই খুব বেশি করে ভাবছি আর অবাক হচ্ছি। সাধ ভ্রমণে যাচ্ছে যেসব যাত্রী তাদেরও স্বজনরা অশ্রুসজল চোখে বিদায় জানাচ্ছে। যারা চিকিৎসা বা কয়েক বছর কাজের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে তাদের বেলায় তো কথাই নেই। নিকট আত্মীয়রা কেঁদে কেটে হয়রান। শতজনের শত কান্নার শব্দে বিমানবন্দর এলাকাটির বাতাসও যেনো কেমন ভারী মনে হয়।

আমাকে উঠিয়ে দিতেও মা এলেন। সাথে এলেন স্বামী ও বাচ্চাসহ আমার একমাত্র বড় বোন। তাদের চোখ অশ্রুসজল। আমি তাদের মুখের দিকে চাইতে পারিনি। কি জানি হয়তো উচ্ছ্বাসে ভরা হৃদয়খানি আমারও কেঁদে উঠবে ঠিক তাদেরই মতো। তাই বেশি বাক্যালাপ না করে নীরবে নিঃশব্দে নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসে পড়ি। বিমান তখন আকাশে। প্রিয় স্বদেশকে এত উপরে থেকে দেখার সৌভাগ্য এর আগে হয়নি। তাই চেষ্টা করে জানালার কাচে চোখ রাখি অফুরন্ত বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকি নীচের দিকে। বিদায়কালে মা বার বার বলে দিয়েছেন, যেয়েই টেলিফোন করবি। তুই সহিসালামতে পৌছুতে পেরেছিস এবং সুস্থ আছিস- এ কথা না জানা পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাব না।

কোনক্রমেই মাকে বুঝাতে পারিনি, ইসলামাবাদে আমার অবস্থান বেশি সময়ের জন্য হবে না । আমি যাচ্ছি এমন এক ভূমিতে, যেখানকার সন্তানরা বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে আজাদীর জন্য লড়াই করে চলেছে। এমনই এক রক্তস্নাত ভূমিতে আমি যাচ্ছি যেখানকার হাজারো মা সন্তান হারানোর বেদনা নিয়ে, হাজারো বোন স্বামী হারিয়ে অকাল বৈধব্য নিয়ে দুঃসহ প্রহর গুনছে মুক্ত সমীরণের প্রত্যাশায়।

বিমানের স্পিকার বক্স আমার ভাবনায় ছেদ টানে। সুমধুর নারী
পরিষ্কার উচ্চারণে বিমানের ইসলামাবাদ উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে। একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। চোখ রগড়ে দেখি ঘড়িতে সাড়ে বারোটা বাজে । বিমান তখন ইসলামাবাদের আকাশে। একদিন এই অঞ্চলটাও আমার দেশের অংশ ছিল। এখন এখানে আসতে পাসপোর্ট ভিসা লাগে । দুই যুগের অধিককাল আগে আমরা তাদের থেকে জুদা হয়েছি। সেই জুদা হওয়াটাও অহিংস ছিল না। রক্ত সাগর পেরিয়েই আমরা নতুন আলোর দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু যে স্বর্ণচূড়াকে মঞ্জিল করেছিল মুসাফির, শ্বাপদসংকুল পথ মাড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছেছিল- দূর থেকে দেখা সেই ভুবনমোহিনী মণিতে যে খামচে ধরা হায়েনার হাত! সেখানে পৌঁছেই সে বুঝে গেল নিমিষে। এখনও সেই মণি নিয়ে মানব দানবে কাড়াকাড়ি চলে- তাই কষ্টার্জিত মণিতে তার হাত পড়লেও এ হাত এখনও কণ্টকমুক্ত হয়নি।

images (20).jpeg

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE BLURT!