”২০০৫ সালে যখন জয়েন করি, তখন থাকতাম এমএইচ হলের পাশের কোয়ার্টারে। ওইখানে যে মানুষ বসবাস করে তাই জানতাম না। আমি যখন নতুন বাসায় উঠলাম, জানালা খোলামাত্রই একটা সাপ পড়লো সামনে। ফ্লোর, বাথরুম সবকিছু স্যাঁতস্যাঁতে, মেইনটেইনেন্সের যে ব্যাপারটি, তা একদমই নেই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ব্যবস্থা কতটা নিম্নমানের তা বোঝাতে কথাগুলো বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ।
বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেল অবস্থা এর চেয়েও খারাপ।
দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংস্কার হয় না। নেই নিয়মিত পরিচর্যা। পুরোনো মডেলে তৈরি একেকটি কোয়ার্টার সংস্কারের অভাবে হয়ে পড়েছে জরাজীর্ণ।
অথচ কোয়ার্টারে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতনের বড় একটি অংশ কেটে নেওয়া হয় বাড়ি ভাড়া হিসেবে।
শিক্ষকরা বেতনের ৫০ শতাংশ দিয়ে থাকেন বাড়ি ভাড়া হিসেবে; এরপরও আবাসস্থলম মানসম্মত নয়। ফলে ক্যাম্পাসের বাইরে থাকাকেই বেছে নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের আবাসন ব্যবস্থা একসাথে। শিক্ষকদের কোয়ার্টার পদমর্যাদার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে।
’এ’ ক্যাটাগরিতে ২৪টি বাসা বরাদ্দ আছে অধ্যাপকদের জন্য। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ৬২টি বাসা রয়েছে সহযোগী অধ্যাপকদের জন্য। ‘সি’ ক্যাটাগরির ৭৪টি বাসা পাবেন সহকারী অধ্যাপকরা। আর ’ডি’ ক্যাটাগরির ১০৪টি বাসা রাখা হয়েছে প্রভাষক এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রারদের জন্য।
যদিও বাসা বরাদ্দের এই নিয়ম মানা হয় না বলা অভিযোগ রয়েছে শিক্ষকদের।
দেখা গেছে, ‘সি’ ক্যাটাগরির বাসায় অধ্যাপক এবং প্রভাষক পাশাপাশি বসবাস করছেন; যেখানে উভয়ের বেতনের ৫০ শতাংশের পরিমাণ কোনোভাবেই সমান নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট অফিস জানিয়েছে, শিক্ষক ও কর্মকর্ত-কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দকৃত ফ্ল্যাটের সংখ্যা ছিলো ৪৭৮ টি। এর মধ্যে এ,বি,সি এবং ডি ক্যাটাগরি মিলিয়ে শুধুমাত্র শিক্ষকদের জন্য ছিলো ২৬৪টি বাসা।
এর বাইরে ‘ই’ এবং ‘এফ’ ক্যাটাগরি হচ্ছে কর্মচারীদের জন্য।
খোঁজখবর করতেই জানা গেলো, শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দকৃত বি-৬১, সি-১৫, বি-৩৮, বি-৩৭, বি-৩৯, বি-৪৬, বি-৪৭, বি-৫৩, সি-১৬, সি-১৭, সি-১৮, সি-৩২, সি-৩৩, সি-৩৪, সি-৩৫, সি-৩৬, সি-৩৮্ সি-১২, বি-৪০, বি-৪৮, বি-৫৫, বি-৫৬, সি-১৩, সি-১৪, সি-২৭ বাসাগুলো বহুদিন ধরে খালি।
বিজ্ঞপ্তি জারি করা হলেও সেখানে থাকতে চাইছেন না শিক্ষকরা। বেতনের ৫০ শতাংশ বেতন দিয়ে এমন মানহীন বাসায় থাকতে ইচ্ছুক নন শিক্ষকদের কেউ।
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান বাবুল বলেন, ”বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক সংখ্যা ৭০৪ জন। কর্মক্ষেত্রের বাইরে আছেন প্রায় ১০০ জনের মত।
“সাতশয়েরও বেশি শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ২০০ জন শিক্ষক কোয়ার্টারে অবস্থান করছেন। এতগুলো বাসা দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা থাকার ফলে প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যেতে বসেছে। ”
আর এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি বিশাল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান বাবুল।
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ বলেন, “বেতনের ৫০ শতাংশ টাকা দিয়ে ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে থাকা কোনো ভাবেই যুক্তিসঙ্গত না।
“বরং ক্যাম্পাসে না থেকে যারা ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এলাকা যেমন আমবাগান, অরুণাপল্লী হাউজিং স্টেট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি প্রভৃতি জায়গায় থাকছেন, সেখানে থাকা আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী এবং মানও অনেক ভালো।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে এই শিক্ষকের পরামর্শ, “বিশ্ববিদ্যালয় যে কাজটি করতে পারতো, তারা কোয়ার্টারের ভাড়া হিসেবে বেতন যে হারে কাটে সেটি কমাতে পারতো।
“যেখানে একই ফ্ল্যাটে একজন প্রভাষক তার বেতনের ৫০ শতাংশ দিচ্ছেন, একজন অধ্যাপকও তার বেতনের ৫০ শতাংশ দিচ্ছেন। এটি কি কোনো ভাবে যুক্তিসঙ্গত হয়?”
তারপরও ক্যাম্পাসে কেন থাকছেন?
সুমন সাজ্জাদ বলেন, “সোশ্যাল সিকিউরিটির ব্যাপারটি এখানে রয়েছে । সেটি ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে সম্ভব হয় না বলে আমি মনে করি।
“দ্বিতীয়ত আমার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলে পড়ে। ...অনেক কিছু বিবেচনা করেই ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে থাকতে হচ্ছে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন। তিনি নিজে থাকেন ক্যাম্পাসের ’সি’ ক্যাটাগরির একটি বাসায়।
অভিযোগ তুলে সুদীপ্ত শাহীন বলেন, “বিশেষ করে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের কোয়ার্টার ছাড়াও কর্মচারীদের যে কোয়ার্টার আছে সেখানে বহিরাগত লোকজনদের বাসা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি বেশ কয়েকবার এমন অব্যবস্থাপনা হাতেনাতে ধরেছেন বলেও জানান।
সুদীপ্ত শাহীন বলেন, তার নিজের বাসার অবস্থাও বেশ নাজুক।
“বৃষ্টি নামলে দেয়াল স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়, চুইয়ে পানি পড়ে ঘরের ভিতর।”
তারপরও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার স্বার্থে এই বাসায় তিনি আছেন অনেকদিন ধরেই।
দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় অথরিটি এই পরিত্যক্ত কোয়ার্টারগুলোকে সংস্কার না করে ফেলে রেখেছে। আবার নতুন মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবে গাছ কেটে নতুন করে কোয়ার্টার নির্মাণ করছে।
“এর যৌক্তিকতা আসলে কতটুকু? প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা এখানে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।”
যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে ইউজিসির অনুমোদন মিলছে না বলেই বাসা ভাড়া কমানোর ব্যাপারে এগুনো সম্ভব যাচ্ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান বাবুল বলেন, “ইউজিসির কাছ থেকে অনুমতি ব্যতীত আসলে বাসাগুলোকে সাবস্ট্যান্ডার্ড ঘোষণা করা সম্ভব না। সেটি যদি করা যায় তবে বাসা ভাড়া কমানো যাবে।
“ইউজিসির এক্ষেত্রে আপত্তি আছে, যেহেতু তারা মনে করছে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তাহলে বাসা ভাড়া কেন কম হবে এখানে?”
তবে শিক্ষকদের বাসস্থানের সংস্কারের ব্যাপারটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরে আছে এবং ধাপে ধাপে এ নিয়ে কাজ করা হবে বলে মন্তব্য করেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার।
শিক্ষকদের আবাসন জটিলতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজের বক্তব্য নিতে গেলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।