পর্ব ০৫ (শেষ )
পরেরদিন সকালে সুমাইয়াকে আদালতে পাঠানো হলো। প্রথম দিন যোগ জিজ্ঞেস করলো। সব কিছুতেই সে অপরাধী প্রমাণিত হলো। শরীর খারাপ থাকায় সেদিন কোর্ট স্থগিত করা হলো।
রাতের বেলা আমি বাসায় গেলাম। প্রথমে ভাবছিলাম সামিয়াকে কিছু শুনাবো না। পরে ওরে সব কিছু বললাম। কিছু সময়ের জন্য সে স্তব্ধ হয়ে যায়।
হওয়ারই কথা, যতোই হোক বোন তো। কিছু না বলে চুপচাপ সে রান্না ঘরে চলে যায়। খাওয়ার সময় আমার পাশে এসে দাঁড়ায়।
আমিঃ কিছু বলবে?
সামিয়াঃ আপু এখন কেমন আছে?
আমিঃ আছে। তবে বেশি ভালো না। তার ব্যাবহার সাইকো প্রকৃতির হয়ে গেছে। শরীরও ভেঙ্গে গেছে।
সামিয়াঃ আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
আমিঃ কি?
সামিয়াঃ যতদিন আপুকে শাস্তি দিচ্ছে না ততদিন আমাদের বাসায় নিয়ে আসুক। আজকে কত বছর দেখি না।
আমিঃ এটা পসিবল না। সে এখন থানায় থাকবে।
সামিয়াঃ দেখেন না কোনো একটা বাহানা দিয়ে নিয়ে আসা যায় কিনা।
আমিঃ আচ্ছা দেখি।
সামিয়াঃ আপুকে নির্দোষ প্রমাণ করা যায় না?
আমিঃ তুমি পাগল হইছো, সবাই জানে সে এই কাজ করেছে। নির্দোষ জীবনেও সম্ভব না।
সামিয়া কিছু না বলে চলে গেলো। চোখের সামনে ওর আগের ঘটনা গুলো ভাসতে শুরু করলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো।
পরেরদিন আমি অফিসে যাই। স্যারের সাথে কথা বলে সুমাইয়াকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলি। প্রথমে স্যার রাজি হয়নি। পরে ওর শারীরিক অবস্থা দেখে হ্যা করলো।
আমি সুমাইয়াকে কয়েকজন মহিলা কনস্টেবল দিয়ে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিই।
বাসা থেকে এসে সুমাইয়া ওর মামলার হাজিরা দিয়ে যায়। আমি খুব একটা বাসায় যাই না এখন। কারন সুমাইয়ার সাথে এক ছাদের নিচে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।
সুমাইয়া প্রায় আমাকে বলতো ” তুমি যখন আমার হওনি, অন্য কাওকেও হতে দিবো না। “
আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম কারন আমার লাইফে যে আছে সে তারই বোন।
এভাবে কিছুদিন চলে যায়। সেদিন আমার রাতে ডিউটি ছিলো। সকালবেলা একটা কনস্টেবল এসে আমাকে একটা চিঠি দেয়।
প্রিয়…
যখন তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে, আমি বুঝতে পারিনি তোমায়। চলে গেছিলাম সুখের ঠিকানায়। ভেবেছিলাম সে তোমার থেকে আমাকে বেশি সুখে রাখবে। কিন্তু না, বরং সে আমাকে ইউজ করেছে। শুধু সে নয়। বিয়ের পর সে তার বন্ধুদের দিয়ে আমাকে ইউজ করাতো। দিনের পর দিন অত্যাচার করতো।
তার অত্যাচারে আমি যখন আবার চলে যাবো ভেবেছিলাম তখন বাড়িতে খবর নিয়ে জানতে পারলাম আমি চলে আসার দিনই বাবা মারা গেছে। তুমি সামিয়াকে বিয়ে করে ফেলছো। যে বুকে আমি থাকার কথা সে বুকে অন্য কেও। ভাবতেও আমার শরীর কাঁপতো।
আম্মুও চলে যায়। মাপ চাওয়ারও সুযোগ পাই নি। তারপর থেকে আমার টার্গেট তুমি। আমি রায়হানকে অনেক আগেই মেরে ফেলতাম। কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। যখন শুনলাম তুমি এই থানায় আছো তখন এই কাজ করে ফেললাম। ওরে হত্যা করলাম কারন আমি জানি তখনিই তোমার সাথে আমার দেখা হবে।
একেক করে যতজন তোমার আর আমার লাইফে আছে সবাইকেই আমি শেষ করে দিবো। তোমার লাইফে অন্য কেউ আমি ভাবতেও পারবো না। সেজন্য আমি আমার বোনকেও ছাড়ছি না। ওরেও আব্বু আম্মুর কাছে পাঠিয়ে দিবো।
চিঠিটা পড়ে আমার হাত পা কাঁপতে লাগলো। আমি বাসার দিকে দৌড় দিলাম। গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। কারণ ওখানে আগে থেকেই পুলিশের গাড়ি আর একটা এম্বুলেন্স আছে।
সাদা একটা কাপড়ে কেউ একজন কে মোড়িয়ে এম্বুলেন্সে ঢুকানো হচ্ছে। বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা সামিয়া।
একটু পর সুমাইয়াকে কয়েকজন মহিলা কনস্টেবল ধরে গাড়িতে তুলতেছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে একটা অট্টহাসি দিলো। আসিফ আমার কাছে আসলো।
আসিফঃ স্যার।
আমিঃ চিঠিটা তুমি আগে পড়েছো?
আসিফঃ না স্যার। আমি সোজা আপনার কাছেই পাঠিয়ে দিয়েছি।
আমিঃ তাহলে এখানে পুলিশ আর এম্বুলেন্স লাগবে তুমি কেমনে জানো?
আসিফ কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সামিয়ার লাশ হাসপাতাল থেকে কাফন পড়িয়ে নিয়ে আসা হলো। আমি রোবট এর মতোই দাঁড়িয়ে রইলাম। সামিয়াকে কবর দিয়ে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্ট ব্যক্তিটা আমি।
কয়েকদিন পরে সুমাইয়াকে আদালতে পাঠানো হলো। তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। খুশি হবো নাকি কাঁদবো সেটাই বুঝছি না।
সামিয়ার কবরের পাশে গিয়ে বসে রইলাম। অফিস থেকে আমাকে কিছু দিনের জন্য ছুটি দেওয়া হলো।
সকালে ফজরের নামাজের পর আসিফ কল দিলো। সুমাইয়া নাকি আত্মহত্যা করেছে। তাড়াতাড়ি করে অফিসে গেলাম। হ্যা আসলেই।
নিজের কাপড় প্যাঁচিয়ে আত্নহত্যা করেছে। স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে একটা অজানা ঝড় এসে পুরো জীবন টা এলোমেলো করে দিলো।
ওরে মর্গে পাঠানো হলো, পোস্টমর্টেম শেষ করার পর স্যারকে বলে ওরে সামিয়ার পাশে দাফন করা হলো।
এখন রাত প্রায় ৯ টা, আমি দাঁড়িয়ে আছি ওদের দুই বোনের কবরের পাশে। জীবনে চেয়েছিলাম খুব সুন্দর ভাবে বাঁচতে। কিন্তু বিধাতা আমাকে কপালে ভালা থাকা লিখে রাখেনি। সুমাইয়ার চলে যাওয়ার পর সামিয়াই আমার সব ছিলো। এতো ভালোবেসে আমায় যেখানে সুমাইয়ার কথা আমার মনেও পড়তো না।
তাকেও চলে যেতে হলো। বাবা চলে যাওয়ার পর মাও একা রেখে চলে গেলো। যাকে ঘিরে বাঁচতে চেয়েছিলাম সেও চলে গেলো।
সুমাইয়াকে করব থেকে তুলে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
গায়ের রং সুন্দর হলে মানুষ সুন্দর হয় না। অনেক টাকা থাকলে মানুষ সুখি হয়না। হয়তো আমি কালো ছিলাম। গরীব ছিলাম। কিন্তু আমারও সুন্দর একটা মন ছিলো। ওর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সম্মান সবই ছিলো। শুধু সেই ছিলো না। টাকা থাকলেই সব সুখ পাওয়া যায় না। সুখ পেতে হলে মন লাগে। ভালোবাসা লাগে।
জীবনের জন্য একা করে সবাইকে নিয়েই সে চলে গেছে। আসলেই সে ঠিক বলেছে, আমার লাইফে অন্য কাওকে সে কখনো সহ্য করতে পারবে না। সেজন্য নিজের বোনকেও ছাড়েনি।
এই মিথ্যে অভিনয়ের পৃথিবীতে আর কাওকে নিয়ে বাঁচতে চাই না। চাই না কারো লাইফে জড়াতে। বাকিটা জীবন নাহয় একাই কাটিয়ে দিবো ওদের কথা স্বরণ করে। থাকুক না কিছু ভালোবাসা অসমাপ্ত হয়ে। কিছু ভালোবাসা অবহেলিত হয়ে। আমি তো জানি আমি কেমন ভালোবেসেছিলাম। সারাজীবন নাহয় ওভাবেই বেসে যাবো।
লেখা – Sagor1233
সমাপ্ত