১৮৫২ সালে রচিত তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’-কেই বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক নাটক হিসেবে ধরা হয়। এরপর দীর্ঘ দেড় শত বছরে বাংলা নাটক নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। রচিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য বহু নাটক। আর তারই মধ্যে থেকে এখানে বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রধান নাট্যকার নাটকের নাম ও প্রকাশকাল করা হলো— ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পূর্বে বাংলা নাটক ও নাট্যচর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ফলে আমাদের এ অঞ্চলে নাটক তেমন বিকশিত হয়নি। দেশবিভাগের পর থেকেই পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ নাটক রচনায় একটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর নাটক রচনা ও নাট্যচর্চায় ব্যাপক রূপান্তর ঘটে। এ সময় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের কারণে বাংলাদেশের নাটকে লাগে পালা বদলের হাওয়া।সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা নাটক। মূলত নাটক দু’শ্রেণির— ট্রাজেডি ও কমেডি। তবে কাহিনির আঙ্গিকে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক, চরিত্র নাটক প্রভৃতি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। নাটকের ইংরেজি প্রতিশব্দ Drama । Drama হচ্ছে গ্রিক শব্দ। যার অর্থ ‘to do’ অর্থাৎ কী করা। নাটকের মধ্যে আমরা অভিনেতা অভিনেত্রীদের কথাবার্তা এবং হাত-পা-মুখ-চোখ নড়াচড়ার মাধ্যমে জীবনের বিশেষ কোনো দিক বা ঘটনার অভিনয় দেখতে পাই।
নির্বাচিত কিছু কথা, যা দিয়েই গড়ে ওঠে নাটকের কাহিনি। এ ক্ষেত্রে টেলিভিশনের সিরিজ নাটকগুলোকে ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কারণ সে নাটকগুলো মঞ্চ নাটকের মতো ৬০ থেকে ৯০ মিনিটের সময়সীমায় বন্দি নয়। সিরিজ নাটকগুলোতে ইচ্ছে করলেই অনেক কথা সেখানে নিয়ে আসা সম্ভব।কাহিনি সাজাতে হলে চরিত্রের প্রয়োজন। কারণ বিশেষ বিশেষ চরিত্র ছাড়া নাটকের কাহিনি দাঁড়াবে কীভাবে? এ জন্য নাট্যকারকে প্রথমেই কতিপয় চরিত্র নির্বাচন করতে হবে। ট্রাজেডি নাটকের চরিত্র কেমন হবে এ সম্পর্কে এ্যারিস্টটল যা বলেছেন, তা মূলত সকল নাটকের চরিত্র সম্পর্কেই প্রযোজ্য। তার মতে, ক. নাটকের চরিত্রের মাঝে ভালো ও মন্দের সমাবেশ থাকবে; খ. নাটকের চরিত্র হতে হবে যথাযথ; গ. নাটকের চরিত্রকে হতে হ
বে বাস্তব; ঘ. নাটকের চরিত্রকে হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
নাটকের কাহিনিকে, চরিত্র ও সংলাপকে অর্থবহ ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য নাট্যকার বিভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেন। নাচ, গান, শব্দ সংযোজন, আলোবিন্যাস— চারটি উপাদান মিলেই গড়ে ওঠে একটি নাটক। এবার প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, উপযুক্ত চারটি উপাদানের মধ্যে কোনটি সবচেয়ে বড় বা প্রধান। না, কোনো উপাদানকেই প্রধান বা অপ্রধান বলা যাবে না। কেননা সব উপাদান মিলেই গড়ে ওঠে একটি নাটক। তবে এ কথা জেনে রাখা ভালো, এক এক যুগে এক একটি উপাদান প্রধান হয়ে দেখা দেয়। সেদিক থেকে কাহিনি এবং চরিত্রের স্থানই উচ্চে। গ্রিক নাটকে কাহিনির প্রাধান্য বেশি, পক্ষান্তরে শেক্সপিয়রের নাটকে চরিত্রের প্রাধান্য বেশি দেখা যায়।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমরা নাটককে শ্রেণিবদ্ধ করতে পারি। আমাদের দেখা শোনা বা পাঠ করা সবগুলো নাটকই কি একই ধরনের? নিশ্চয়ই না। হয়তো কোনো নাটক দেখে হেসেছি, কখনো কেঁদেছি, কখনও পেয়েছি আনন্দ, কখনো বেদনায় হয়েছি বিমর্ষ।কোনো কোনো নাটকে দেখা যায় সমাজের বিশেষ কোনো ঘটনা বা চিত্র। ঐতিহাসিক কোনো চরিত্রের বিজয় কাহিনি কিংবা তার পতন ও পরাভবের ইতিহাস।
খ্রিস্টপূর্বকাল থেকেই গ্রিক দেশে নাট্যচর্চার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা জানা যায়। পেরিফ্লিসের গ্রিক এবং পরবর্তীকালে এলিজাবেথের ইংল্যান্ডে নাট্যচর্চার ব্যাপক সমৃদ্ধি এসেছিল। প্রাচীন ভারতবর্ষেও সংস্কৃতি নাটক খুব সমৃদ্ধ ছিল। বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশেই প্রায় নাট্যচর্চা আছে।
১৭৯৫ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে বাংলা নাটক বিকশিত হয়েছে। তবে ১৭৯৫ সালে প্রথম বাংলা নাটকের সাক্ষাৎ পাওয়া গেলেও, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির নানা শাখায় বিপুল পরিমাণ নাট্য-উপাদান বহুপূর্ব থেকেই ছিল। মঙ্গলকাব্য, লোকসঙ্গীত, পালাগান, গাজীরগান, কবিগান, ময়মনসিংহ গীতিকা প্রভৃতির মধ্যে বাংলা নাটকের নানা উপাদান পাওয়া যায়। লোকনাটকের অন্যতম উপাদান নৃত্য ও সঙ্গীতের সাক্ষাৎও। আমরা এসব রচনায় খুঁজে পাই এবং কালক্রমে এসব উপাদান থেকেই আধুনিক যুগের বাংলা নাটকের উদ্ভব ঘটে। ১৭৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর কলকাতার বেঙ্গলি থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় প্রথম বাংলা নাটক ‘কাল্পনিক সংবদল’। রুশদেশীয় যুবক গেরাসিম স্তেপানভিচ্ লেবেদেফ ইংরেজি নাটক ‘দ্য ডিসগাইজ’-এর বাংলা রূপান্তরিত নাম ‘কাল্পনিক সংবদল’। নাটকটি বাংলায় রূপান্তর করতে গিয়ে লেবেদেফ পণ্ডিত গোলনাথ দাসের সহায়তা নেন।
সুতরাং এমন কারণে নাটকের কতগুলো ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন : ক্ল্যাসিকাল, রোমান্টিক, বাস্তববাদী, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক, চরিত্রমূলক, ট্রাজেডি, কমেডি, মেলোড্রামা, ট্র্যাজিকমেডি, প্রহসন, সমস্যামূলক, রূপকনাট্য, সাঞ্চেতিক, অভিব্যক্তিবাদী, অ্যাবসার্ড, লোকনাট্য, গীতিনাট্য, মহাকাব্যিক, পথনাটক ইত্যাদি।
বাংলা নাটকের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। কিন্তু আধুনিক অর্থে আমরা যাকে নাটক বলি, বাংলা ভাষায় তা প্রথম পাই আজ থেকে দুইশ’ বছর পূর্বে।
নাটকের গঠন কৌশল নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা করেন গ্রিক মনীষী এ্যারিস্টটল। তার মতে, তিনটি বিষয়ের ঐক্যই একটি নাটকের গঠন কৌশলের প্রধানতম ভিত্তি। কালের ঐক্য, স্থানের ঐক্য ও ঘটনার ঐক্য। কালের ঐক্য বলতে আমরা বুঝি, নাটক যত সময় (মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে) মঞ্চে অভিনীত হবে, সে সময়ের মধ্যে যা কিছু ঘটা সম্ভব, নাটকে কেবল তাই-ই ঘটানো যাবে। তবে এ তত্ত্ব আধুনিককালের নাটকে সর্বাংশে প্রযোজ্য নয়। স্থানের ঐক্য হলো, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নাট্য চরিত্রসমূহ যতটা স্থান পরিবর্তন করতে পারে, নাটকে ততটাই দেখানো যাবে।
১৯৪৭ সালের পূর্বে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক হলো—
আকবরউদ্দিন— সিন্দু-বিজয় (১৯৩০), সুলতান মাহমুদ (১৯৩০), নাদির শাহ (১৯৫৩)।
শাহাদাৎ হোসেন— সরফরাজ খাঁ (১৯২১), আনার কলি (১৯৪৫), মসনদের মোহ (১৯৪৬)।
ইব্রাহীম খাঁ— কামাল পাশা (১৯২৯৮), আনোয়ার পাশা (১৯৩২)।
ইব্রাহীম খলিল— স্পেন বিজয়ী মুসা (১৯৪৯)।
শওকত ওসমান— তস্কর ও লস্কর (১৯৪৫), কাঁকরমনি (১৯৪৯)।
১৯৪৭ সালের পর বংলাদেশের নাট্যকাররা ঐতিহাসিক নাটকের পাশাপাশি সামাজিক নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন।১৯৪৭ থেকে প্রাক-মুক্তিযুদ্ধে কালপর্বে যারা নাটক লিখেছেন তারা হলেন— নুরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সিকান্দার আবু জাফর, সাঈদ আহমদ, আসকার ইবনে শাইখ ও জিয়া হায়দার।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যকে প্রধানত পাঁচটি শাখায় বিন্যস্ত করা হয়। ক. মুক্তিযুদ্ধের নাটক, খ. প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের নাটক, গ. ইতিহাস-ঐতিহ্য পুরাণ পুনর্মূল্যায়নধর্মী নাটক, ঘ. অনুবাদ ও রূপান্তরিত নাটক, ঙ. সামাজিক নাটক।
অনুবাদ ও রূপান্তরকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন— কবীর চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, মমতাজউদ্দীন আহমদ, আলী যাকের, জিয়া হায়দার, আসাদুজ্জামান নূর, খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রমুখ।
সমাজের অবক্ষয়, মূলবোধের বিচ্যুতি আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিপথগামিতা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক নাটক। এ ধারায় উল্লেখযোগ্য নাটক রচনা করেছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। এ ছাড়াও অন্য যে সব নাট্যকার সামাজিক নাটক রচনায় বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন, তারা হলেন— সৈয়দ শামসুল হক, মমতাজউদ্দীন আহমদ, রশীদ হায়দার, আতিকুল হক চৌধুরী, সেলিম আল দীন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, এস এম সোলায়মান, আল মনসুর, গোলাম আম্বিয়া নূরী প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র্র করে যে সব নাট্যকার নাটক লিখেছেন তারা হলেন—
মমতাজউদ্দীন আহমদ— ‘স¦াধীনতা আমার স্বাধীনতা’ (১৯৭৬), ‘বকুলপুরের স্বাধীনতা’ (১৯৮৬), ‘বিবাহ’ ও ‘কি চাহ শঙ্খচিল’ (১৯৭৬)।
জিয়া হায়দার— ‘সাদা গোলাপে আগুন’ (১৯৮২), ‘পঞ্চজ বিভাস’ (১৯৮২)।
আলাউদ্দিন আল আজাদ— ‘নিঃশব্দ যাত্রা’ (১৯৭২), ‘নরকের লাল গোলাপ’ (১৯৭৪)।
মোহাম্মদ এহসানুল্লাহ— ‘কিংশুক যে মরুতে’ (১৯৭৪)।
নীলিমা ইব্রাহীম— ‘হে জনতা আরেক বার’ (১৯৭৪) প্রমুখ।
প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের চেতনায় বাংলাদেশের নাটকের প্রধান প্রবণতা। এ ধারায় উল্লেখযোগ্য নাটক ও নাট্যকাররা হলেন—
মামুনুর রশীদ— ‘ওরা কমদ আলী’ (১৯৮৬), ‘ইবলিশ’ (১৯৮২), ‘এখানে নোঙর’ (১৯৮০), ‘গিনিপিগ’ (১৯৮৬)।
আব্দুল্লাহ আল মামুন— ‘শপথ’ (১৯৭৮), ‘সেনাপতি’ (১৯৮০), ‘এখনও ক্রীতদাস’ (১৯৮৪)।
মমতাজউদ্দীন আহমদ— ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’ (১৯৯১)।
সেলিম আল দীন— ‘করিম বাওয়ালীর শক্র বা মূল মুখ দেখা’ (১৯৭৩), কীর্তনখোলা’ (১৯৮৬)।
রাজীব হুমায়ুন— ‘নীল পানিয়া’ (১৯৯২)।
আবদুল মতিন— মাননীয় মন্ত্রীর একান্ত সচিব’ (১৯৮০)।
আবদুল মতিন খান— ‘গিলগামেশ’ (১৯৮২) ইত্যাদি।
সৈয়দ শামসুল হক— ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ (১৯৮২)।
এস এম সোলায়মান— ‘ইঙ্গিত’ (১৯৮৫), ‘এই দেশে এই বেশে’ (১৯৮৮)।
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালের ইতিহাস-ঐতিহ্য পুরাণের অনুষঙ্গে নাটক রচনায় এক নতুন মাত্রা সঞ্চারিত হয়। আর এ ধারায় উল্লেখযোগ্য নাটক এবং নাট্যকাররা হচ্ছেন—
সৈয়দ শামসুল হক— ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ (১৯৮২)।
সাঈদ আহমদ— ‘শেষ নবাব’ (১৯৮৯)।
মমতাজউদ্দীন আহমদ— ‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা’ (১৯৭৬)।
সেলিম আল দীন— ‘অনিকেত অন্বেষণ’, ‘শকুন্তলা’ (১৯৮৬)।
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের অন্যতম প্রবণতা বিদেশি নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তকরণ। এ সময়ে যেসব নাট্যকারের নাটক অনূদিত কিংবা রূপান্তরিত হয়েছে। তারা হলেন— শেক্সপিয়র, মলিয়ের, মোলনার, বেকেট, ইয়োসেনেস্কো, ব্রেখট, সার্ত, কাম্যু, এ্যালবি প্রমুখ।