এই বিশাল পৃথিবীতে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি মানুষের বসবাস রয়েছে। ছোট-বড় নানা দেশে তারা বাস করে। এইসব দেশে রয়েছে বহু রকমের সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতি । সেগুলো কিনা প্রত্যেকটি অন্যটির থেকে একটু হলেও আলাদা কিন্তু যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। এই টিকে থাকার পেছনের মূল কারণ হলো সেই সমাজের সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট কিছু মূল্যবোধ ও নিয়ম-নীতি যেগুলো মানুষ মেনে চলে, পালন করে। ফলে সমাজে কোনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় না। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সমাজকে সকল প্রকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাত, দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ থেকে দূরে রাখে। ফলে মানুষ সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে বেঁচে থাকে।( নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ রচনা)
নৈতিকতা কী
নৈতিকতা হলো নীতি সম্পর্কিত একটি বোধ,ইহা একটি মানবিক গুণাবলী যা অন্য আরো অনেক গুণের মিশ্রণে বা সমন্বয়ে তৈরি হয়। মানুষ তার সমাজ,পরিবার, রাষ্ট্র ও ধর্মের ওপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি মেনে চলে খুব সচেতনভাবে । রাষ্ট্র বা সমাজ আরোপিত এই সব নিয়ম-নীতি ও আচারণবিধি মানুষের জীপন-যাপনকে প্রভাবিত করে। এই নিয়মগুলো মেনে চলার প্রবণতা, মানসিকতা, নীতির চর্চাই হলো নৈতিকতা।
মূল্যবোধ কী
অনেক মানুষ আছে যারা মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে এক মনে করেন। কিন্তু দুটি বিষয় কখনো এক নয়। দীর্ঘদিন একই সমাজে একসাথে বাস করার ফলে অর্জিত মানবীয় অভিজ্ঞতা থেকে মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। মূল্যবোধের ভিত্তি বা মূল স্থান হলো দর্শন ,ধর্ম , দীর্ঘ দিনের লালিত আচরণ-বিশ্বাস, সমাজের নিজস্ব নিয়ম-নীতি ওআদর্শ । সমাজে বিদ্যমান রীতি-নীতি ও প্রথার প্রেক্ষিতে ভুল-সঠিক,ভালো-মন্দ,, কাঙ্কিত, অনাকাঙ্কিত বিষয় সম্পর্কে সমাজের মানুষের যে ধারণা সেগুলোই হলো মূল্যবোধ।
বর্তমান সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবস্থান
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে যে ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ।’ এই প্রবাদটিকে আসেলে সত্যি প্রমাণ করার জন্যই যেন বর্তমান এই সমাজ ব্যবস্থা থেকে সব ‘ভালো’ এক এক করে উঠে যাচ্ছে। আগে মানুষ বিশ্বাস করতো ধনের চেয়ে মান অনেক বড় বিষয়। অথচ এখন এই একই ধারণা পাল্টে গেছে। প্রত্যেকেই এখন অবিরাম ছুটে চলেছে বিত্ত ও অর্থ-সম্পদের পেছনে। একজনকে পেছনে ফেলে আর একজনের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা প্রত্যেককে করে ফেলেছে অন্ধ। প্রত্যেকে অবলীলায় বিসর্জন দিচ্ছে নিজস্ব নৈকিতা আর মূল্যবোধকে। তাই এখন সমাজের নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত সবটাই ডুবে গেছে দুর্নীতি, অপকর্ম আর অনৈতিক কর্মকান্ডে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে মানুষ এমন করে নির্বাসিত বা ফেলে দিয়েছে যে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় প্রধানরাও হর-হামেশাই জেলে যাচ্ছেন দুর্নীতির দায়ে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রই আজ নীতিহীনতায় জর্জরিত বা মিশ্রত। মূল্যবোধের চর্চাকে এখন বোকাদের কাজ বলে বিদ্রুপ করা বা হাসা হয়। একটা সময় ছিল যে যখন একজন দরিদ্র্য অথচ নীতিবান মানুষকে সকলেই সম্মানের নজরে দেখত। আর এখন টাকা যার সম্মান তার। তাই আমরা দুর্নীতি পরায়ণ ,ঘুষখোরআর সুদ-কারবারী মহাজনদের সম্মান করি, সংবর্ধনা দেই। এই অবস্থা চলতে থাকলে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে কিছুদিন পরে রূপকথার গল্পে খুঁজতে পেতে হবে।
নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়
অবক্ষয় বলতে যেকোনো কিছুর ক্ষয় প্রাপ্তিকে বোঝায় বা বুঝিয়ে থাকে। অর্থাৎমূল্যবোধ ও নৈতিকতা যখন বিলোপ হয়, বিনষ্ট হয়, মানুষ মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করে তখন তাকে মূল্যবোধের অবক্ষয় বলে। আমাদের দেশের যুব-সমাজের দিকে তাকালে এই অবক্ষয়ের এক করুণ ও প্রত্যক্ষ চিত্র আমরা দেখতে পাই। লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এই অবক্ষয়ের কারণে নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারের পথে, আসক্ত হচ্ছে মাদকে। ছিনতাই, অপহরণ, গুম, খুন, হানাহানি, নষ্ট রাজনীতি আর সন্ত্রাসে প্রতিনিয়ত জড়িয়ে যাচ্ছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে গলা টিপে হত্যা করে মূল্যবোধ আর নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সব বয়সী মানুষ আজ চলেছে ধ্বংসের পথে। যে ছেলেটির হওয়ার কথা শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা প্রশাসক সে আজ হয়ে যাচ্ছে চোরাচালানকারী, মাদক ব্যবসায়ী কিংবা সন্ত্রাসী। যার দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সে আজ অন্যায় করে ব্যাহত করছে দেশের অগ্রযাত্রাকে। এসব কিছুর জন্য আসলে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ই দায়ী।
পৃথিবীতে কেউই পাপী কিংবা অপরাধী হয়ে জন্মায় না। মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা সমাজ ব্যবস্থাই তাকে ভালো কিংবা খারাপ করে গড়ে তোলে। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ তাই দুটি দিক থেকে বিবেচনা করা যায়- প্রথমতঃ পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক কারণ, দ্বিতীয়তঃ অর্থনৈতিক কারণ।
অর্থনৈতিক কারণ
কথায় বলে ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়’। সত্যিকার অর্থে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত একজন মানুষ নীতি ও মূল্যবোধে দৃঢ় থাকতে পারে না। কারণ দারিদ্র্য কখনো কখনো মানুষকে বিমূঢ় করে দেয়। নিজের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাতে, দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে মানুষ তাই অনেক সময় বেছে নেয় অসৎ পথকে। সে ভুলে যায় তার নীতি কথা ও মূল্যবোধকে। আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক বিভিন্ন কর্মকান্ডের জবাবদিহিতার তেমন কোনো চর্চা নেই। ফলে আমাদের আমলা থেকে মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা পর্যন্ত মূল্যবোধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এর অপব্যবহার করেন।
পারিপার্শ্বিক বা সামাজিক কারণ
একসাথে চলতে গেলে একজন মানুষ খুব সহজেই আর একজনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর তাই অসৎসঙ্গে পড়ে কেউ কেউ তার নীতি নৈতিকতাকে, মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তরুণ-তরুণী বা কিশোর-কিশোরীরা অন্য বন্ধুর প্ররোচনায় মাদকে আসক্ত হয়। কেউ কেউ আবার ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কলহপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। পরিবারের সদস্যদের নেতিবাচক মনোভাব, নীতিহীনতা, মূল্যবোধের প্রতি অশ্রদ্ধা মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে পরিবারের কাছ থেকে ব্যক্তি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা পায় না। আর যেটুকু সহজাত থাকে তাও হারিয়ে ফেলে।
অনেক সময় মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উচ্চাভিলাস তার নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটায়। অধিক সুখ আর বিলাসী জীবনের আশায় মানুষ যখন বিপথগামী হয় তখন সে মূল্যবোধকে অবলীলায় ভুলে যায়। এছাড়া নিরক্ষরতা, শিক্ষা সংকট এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকার কারণেও মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়।
অবক্ষয়রোধে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ
এই চলমান অবক্ষয়কে থামাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের চর্চা। যে ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক শিক্ষা থাকে, মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে সে ব্যক্তি সকল অপরাধ থেকে বিরত থাকে। বরং সে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যে ব্যক্তির নৈতিক শিক্ষা নেই, যে মূল্যবোধের মর্ম বোঝে না তার কাছে এগুলো শুধুই ‘পুঁথিগত শব্দ’ সে এগুলোর মূল্য দিতে জানে না। তাই অবক্ষয়কে রুখতে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ চর্চা দুটোই অপরিহার্য।
নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা
শুধুমাত্র অবক্ষয় রোধের জন্যই নয় বরং জীবনকে সুন্দর করে তোলার জন্য নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রয়োজন। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি তার নীতিতে অটল থাকে, মূল্যবোধের ওপর আস্থা রাখে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন একজন মানুষকে সঠিক ও শুদ্ধ মানুষ রূপে গড়ে তোলে তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ থাকার কারণেই মানুষ তার নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতি সকল দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ অন্যকেও উৎসাহিত করে নীতিবান হতে, মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখাতে। যার মধ্যে নৈতিক শিক্ষা থাকে পারিপার্শ্বিকতার দোহাই দিয়ে সে অন্যায়-অপরাধ করে না। বরং সে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে।
নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ অর্জনে করণীয়
মানুষের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার। তাই নৈতিক শিক্ষা আর মূল্যবোধের শিক্ষাও শুরু হয় পরিবারে। পরিবারের উচিত তার শিশুকে নৈতিক শিক্ষা দেয়া এবং সামাজিক মূল্যবোধগুলো জানানো। পরিবারের উচিত শিশুদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া। কারণ ধর্ম নৈতিকতা শেখায়, মূল্যবোধ শেখায়। আমাদের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যসূচীতে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার উপযোগী বিষয়বস্তু থাকতে হবে। অন্যের সংস্কৃতি অন্ধভাবে অনুকরণের যে চেষ্টা তা সচেতনভাবে পরিহার করতে হবে। গণমাধ্যম থেকে আমরা অনেক কিছু শিখে থাকি। তাই গণমাধ্যমগুলোতে এমন বিষয় প্রচার করা উচিত যেগুলো থেকে মানুষ নৈতিক শিক্ষা পাবে এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে জানবে। মানুষের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজে থেকে সচেতন হতে হবে।
একটি জাতির নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সেই জাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক গতি-প্রকৃতি ও অবস্থানকে তুলে ধরে। যে জাতি যতো বেশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজস্ব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সে জাতি ততো বেশি সুসংহত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ মানুষকে ন্যায়ের পথে, কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। অন্যায়-অবিচার করা থেকে মানুষকে দূরে রাখে। যে ব্যক্তি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত, যে নিজের মূল্যবোধকে সম্মান করে সে ব্যক্তি সর্বদাই নিষ্কলুষ থাকে।