স্বপ্নের পদ্মা সেতুসহ সড়ক সম্প্রসারণ-নতুন সড়ক নির্মাণ-সড়ক প্রশস্তকরণে আধুনিক-যুগোপযোগী পরিকল্পনায় যথার্থ সার্থক-নান্দনিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। দেশকে বিশ্বপরিমণ্ডলে মর্যাদাসীন করার ক্ষেত্রে উল্লেখ্য উদ্যোগ অতুলনীয় অভিধায় অভিষিক্ত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এর বিপরীতে কঠিন এক জীবন সংহারের দৃশ্যপটও নির্মিত হয়েছে। যান-পরিবহণ দুর্ঘটনা যেভাবে প্রতিনিয়ত প্রাণ নিধনের দুর্বিষহ প্রতিযোগিতায় নেমেছে; পুরো জাতি এতে চরম বিচলিত-আশঙ্কাগ্রস্ত। ঘর থেকে বেরোনোর সময় কেন যেন এক অজানা মৃত্যুভয় ছায়ার মতো মনের অগোচরে বাসা বেঁধে চলছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রাণপণ প্রচেষ্টায়ও এর পরিত্রাণে কার্যকর কোনো সুফল দৃশ্যমান নয়। দোষারোপের তর্জনী ইঙ্গিতে সংকট দূরীভূত হওয়ার পরিবর্তে আরও যেন ভয়াবহতায় প্রতিফলিত হচ্ছে। বিভিন্ন ছাত্র-জনতার আন্দোলন-সংগ্রামেও রাজপথ কম্পিত হয়েছে। জনগণ আর বাচনিক কোনো অঙ্গীকারে নয়; প্রায়োগিক পন্থা অবলম্বনে এ সংকটের আশু সমাধান প্রত্যাশা করছে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে চট্টগ্রামের চকরিয়ায় বাবার শ্রাদ্ধকর্ম শেষে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ৫ ভাইয়ের মৃত্যুর মর্মস্পর্শী ঘটনা দেশবাসীকে প্রচণ্ড মর্মাহত করেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, রাস্তা পার হওয়ার সময় কক্সবাজারমুখী দ্রুতগামী নম্বরবিহীন একটি পিকআপের চাপায় তাদের মৃত্যু হয়।
৯ জানুয়ারি ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন সূত্রমতে, ২০২১ সালে দেশব্যাপী সংঘটিত ৫ হাজার ৩৭১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৬ হাজার ২৮৪ এবং আহত হয়েছে ৭ হাজার ৪৬৮ জন। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। এই হিসাবে গত বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ১৩ শতাংশই শিক্ষার্থী। শুধু মে মাসে সর্বাপেক্ষা ৮৪ জন এবং জুন মাসে সবচেয়ে কম ৫৩ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়। এদের বড় অংশ নিহত হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ এবং প্রায় ১৭ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়।
করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছর কয়েক ধাপে পুরো দেশে কঠোর বিধিনিষেধকালে মোট ৮৫ দিন গণপরিবহণ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন। সংস্থাটির মতে, প্রতিদিন সড়কে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের বেশি মানুষের। আর ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৮৫ দিন গণপরিবহণ বন্ধ থাকার বিষয়টি হিসাবে নেওয়া হলে দৈনিক গড় মৃত্যুর হার দাঁড়ায় ২২ জনের বেশি।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ২ হাজার ২১৪ জন। ২০২০ সালের তুলনায় যা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৫১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। নিহতদের অধিকাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো ও ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমান নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখের বেশি।
২০১৯ সালের ২০ অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী, এ সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ৯৫৪টি। বিপরীতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৯০৩টি। অর্থাৎ সড়কে অবৈধভাবে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে ১৪ লাখ ২৬ হাজার ২৫১ জন চালক। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য পত্রপত্রিকায় আসে না।
গণমাধ্যমে যে পরিমাণ তথ্য প্রকাশিত হয়, প্রকৃত দুর্ঘটনা তার চেয়ে চার বা পাঁচ গুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শুধু কমিটি গঠন এবং সুপারিশ করার চক্র থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। এসবের চেয়ে বেশি প্রয়োজন জনবান্ধব পরিবহণ কৌশল প্রণয়ন করা।’
বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত গণমাধ্যমের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বিআরটিএ’র হিসাবে প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ জন প্রাণ হারায়। সে হিসাবেও বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮০০ জন। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বছরে ১২ হাজার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০ হাজার মানুষ প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ : লিডারশিপ প্রায়োরিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মারা যায় ১০২ জন।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভুটান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকায় এ সংখ্যা যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৭০, ১৩, ৪০ ও ৭ জন। যদিও বাংলাদেশে প্রতি হাজারে যানবাহন আছে মাত্র ১৮ জনের। ভারতে এ সংখ্যা ১৫৯, নেপালে ৮১, ভুটানে ১০৯ ও শ্রীলংকায় ৩২৭। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের দুর্ঘটনায় গড়ে ২ জন সাইকেল চালকের মৃত্যু হয়। দুই বা তিন চাকার মোটরযানের ক্ষেত্রে এর সংখ্যা ১১ দশমিক ২০, গাড়ি ও হালকা যানের ক্ষেত্রে ১৩ দশমিক ৩০ জন গাড়ি চালক ও ২৮ দশমিক ৬০ জন যাত্রী। আবার ট্রাক চালকদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৬ দশমিক ১০, বাস চালকদের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ২০ বাস যাত্রীর সংখ্যা ২৮৬ দশমিক ৬০ জন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
ওয়ার্ল্ড হেলথ র্যাংকিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। ৬১ দশমিক ৯০ শতাংশ মৃত্যুহার নিয়ে সবচেয়ে অনিরাপদ রাস্তার তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে জিম্বাবুয়ে। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার ২ দশমিক ৩১ শতাংশ হার নিয়ে সর্বাপেক্ষা নিরাপদ সড়কের তালিকায় শীর্ষে আছে সুইডেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় বেশিরভাগ দেশের জিডিপির ৩ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ৯৩ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটছে বিশ্বের মোট সড়ক যানের ৬০ শতাংশ থাকা স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশে।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্ন সংস্থা-মহল কর্তৃক চিহ্নিত কারণগুলো হচ্ছে-চালকের অসাবধানতা-অদক্ষতা ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, রাস্তার স্বল্পতা-অপ্রশস্ততা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের চলাচল, প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালানো ও ওভারটেকিং, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা, রাস্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার না থাকা, ওভারব্রিজের স্বল্পতা, সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতা, ফুটপাত হকারদের দখলে থাকা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়কের ওপর অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা, যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পথ অবরোধ-সভা ও হরতালসহ প্রভৃতি কারণে সৃষ্ট যানজটে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত হওয়া, সড়ক পরিবহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থা-প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা ইত্যাদি। ২০২১ সালে সংঘটিত দুর্ঘটনার ৬২ শতাংশের কারণ যানবাহনের বেপরোয়া গতি বলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের উপরোল্লেখিত প্রতিবেদনে উপস্থাপিত হয়েছে।
সুশীলসমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংস্থার জোরালো দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২২ অক্টোবর ২০১৯ ‘সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮’ কার্যকরের তারিখ ঘোষণা করেছে। সব ধরনের সাজা বাড়িয়ে নতুন আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নতুন আইনে ট্রাফিক সংকেত ভঙ্গের জরিমানা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার, হেলমেট না পরলে জরিমানা ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০০০০ নির্ধারণ করেছে, সিটবেল্ট না বাঁধলে-মোবাইল ফোনে কথা বললে চালককে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করলে তিন লাখ টাকা জরিমানা ও তিন বছরের জেল হওয়া।
চালকদের লাইসেন্স পেতে অষ্টম শ্রেণি ও সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাশসহ ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট রাখা হয়েছে। আইনভঙ্গে জেল-জরিমানা ছাড়াও লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা এবং ১২ পয়েন্ট কাটা গেলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া গাড়ি চালনা সংক্রান্ত ধারা ১৬ এর বিধান লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার-প্রদর্শন সংক্রান্ত ধারা ১৭-এর বিধান লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ দুই বছর থেকে কমপক্ষ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিষয়সহ আরও অনেক বিধিতে জরিমানা বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে নতুন সড়ক পরিবহণ আইন সংশোধনের দাবি উত্থাপিত হলেও এর কোনো সুরাহা এখনো হয়নি। দাবি উত্থাপন কতটুকু যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য, এ সম্পর্কে নিবিড় বিশ্লেষণ প্রয়োজন। দুর্ঘটনার কারণগুলো কমবেশি চিহ্নিত হলেও এর থেকে পরিত্রাণের জন্য আশু-স্বল্প-দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার যথাযথ আইনি-সচেতনতামূলক গণপ্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।