১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখের শুভ লগ্নে কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও মা সারদাদেবীর কোল আলো করে যে শিশু জন্ম নিল সে বিশ্বের কবি আমাদের রবি— রবীন্দ্রনাথ । শৈশবে বিভিন্ন স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয় বিদ্যার্জন করার জন্য কিন্তু শিশু রবীন্দ্রনাথের কাছে চার দেওয়ালে আবদ্ধ বিদ্যালয় বা প্রথাগত শিক্ষা কোনোটাই গ্রহণ যোগ্য হয় নি । বাড়ির অনুকূল পরিবেশে এবং পিতার সান্নিধ্যে থেকেই তিনি প্রকৃত শিক্ষা লাভ করেন । তিনি প্রাচীন ভারতবর্ষের তপোবনে যে ভাবে শিক্ষাদান কার্য সম্পাদিত হত সেই আদর্শকেই জীবনে গ্রহণ করেছিলেন । পরিণত বয়সে শান্তিনিকেতনে তিনি আশ্রমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন । প্রকৃতির মুক্তাঙ্গনে বসে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিতেন । তিনি এখানে শিক্ষক নন, তিনি হলেন গুরুদেব ।
রবীন্দ্রনাথ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন । তবে তাঁর সবথেকে বড় পরিচয়— তিনি কবি । বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি । সোনারতরী, ক্ষণিকা, মানসী, পূরবী, চিত্রা, গীতালী, গীতাঞ্জলির মতো অজস্র কাব্য-কবিতা, ডাকঘর, রাজা, রক্তকরবী, বিসর্জন, মুক্তধারা প্রভৃতি অসামান্য নাট্যসম্ভার, বৌঠাকুরানীর হাট, গোরা, চতুরঙ্গ, ঘরে বাইরে প্রভৃতির মত উপন্যাস, ছুটি, সুভা, দানপ্রতিদান, পোস্টমাস্টার, দেনাপাওনা অতিথির মতো অসংখ্য ছোট গল্প যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে । শিক্ষা, দর্শন, রাজনীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় নিয়ে লিখেছেন একাধিক প্রবন্ধ । আর সঙ্গীত— এখানে এর কোনো তুলনা করা যাবে না । রবীন্দ্রসংগীত বিশাল সমুদ্রের মতো । সংগীত রচয়িতা হিসাবে তিনি রাজাধিরাজ । প্রেম, প্রকৃতি, পূজা ঈশ্বরভাবনা সবকটি দিকেই রয়েছে অজস্র গানের ডালি ।
দেশে বিদেশে বহু জায়গায় তিনি আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছেন বা ভ্রমণ করেছেন । বাইরের জগৎ থেকে কিছু বিষয় তিনি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন অসামান্য সব গীতিনাট্য, নাট্যকাব্য যেমন— বাল্মীকির প্রতিভা, চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, চন্ডালিকা, প্রভৃতি, যেগুলি একেবারে নতুন আঙ্গিকে তিনি নিজে অভিনয় করে দেখিয়েছেন । প্রতিটি নাটক, নৃত্যনাট্যয় তিনি মানবতার চরম সত্যকে প্রকাশ করেছেন ।
রবীন্দ্রনাথ সামান্য একজন মানুষ নন— তিনি মহামানব । তাঁর মধ্যে মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, ভগবৎপ্রেম সব কিছুই এত সুন্দর ভাবে ও এমন পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পেয়েছে যা সত্যি অতি বিস্ময়কর । মানবপ্রেমিক কবি আমাদের শিখিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসতে, ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে । মানুষেরে ভালোবাসলে ভাগবানকে ভালবাসা হয়—
" যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে ।
সবার পিছে, সবার নীচে সবহারাদের মাঝে ।"
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ও গানে তরুণদের সর্বদা কবি উদ্দীপিত করেছেন—
" ওরে নতুন যুগের ভোরে
দিসনে সময় কাটিয়ে বৃথা
সময় বিচার করে ।
চলায় চলায় জাগবে জয়ের ভেরী
পায়ের বেগে পথ কেটে যায়
করিস না আর দেরী । "
নারীকে সম্মান করেছেন । নারী শুধু ভোগ্যপণ্য নয় তার আপন সত্তায় সে মহীয়ান হতে পারে সে কথা তিনি বহু কবিতায় গানে বলেছেন । প্রকৃতি প্রেম তাঁর কাব্য কবিতায় এমন সুন্দরভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে যার কোনো তুলনা নেই । প্রতিটি ঋতু— গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত যেন এক একটি জীবন্ত চরিত্র । 'এসো হে বৈশাখ', 'শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি' প্রভৃতি গানের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি ঋতুর সুন্দর বৈশিষ্ট্য যেভাবে পাই আর কোথাও সেভাবে পাওয়া যায় না ।
ঈশ্বরচিন্তা বা পূজাপর্যায়ের গানের মধ্যে দিয়েই তিনি দেখিয়েছেন যে, দেবতা কোনো বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ থাকেন না যেখানে
"তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙ্গে করছে চাষা চাষ
পাথর ভেঙ্গে কাটছে যেথায় পথ, খাটছে বারো মাস
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে ।"
তিনি সঙ্গী হয়ে আছেন সবার সাথে । কারণ
" ভজন মন্দিরে তব
পূজা যেন নাহি রয় থেমে,
মানুষে কোরো না অপমান
যে ঈশ্বরে ভক্তি করো,
হে সাধক মানুষের প্রেমে
তারি প্রেম করো সপ্রমাণ ।"
এত বছর পরেও রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও সৃষ্টি দারুন ভাবে আজকের সমাজে প্রাসঙ্গিক । কারণ রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও সৃষ্টি আমাদের এই অস্থিরময় জীবনে সঠিক পথের দিশা দেখাতে পারে, পারে আত্মগ্লানির হাত থেকে মুক্তি দিতে । দমবন্ধকর আবহাওয়া থেকে একটু খোলা হাওয়া এনে দিতে পারে রবীন্দ্রসংগীত । 'আলোকের এই ঝর্ণা ধারায়' কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মানুষ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে । ২৫শে বৈশাখের এই সকালে কবিগুরুকে আমার অন্তরের প্রণাম জানিয়ে শেষ করলাম আমার কথা ।