বাংলাদেশে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের আশুতোষ নাথ এখন অনেকের কাছে পরিচিত নাম। অফিস সহকারী থেকে তিনি এখন পূর্ণ বৃত্তিসহ আমেরিকার বোস্টনের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসে পিএইচডি করছেন। দেশে থাকতে ছাত্রজীবনে চাকরি পেতে কীভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন এই পিএইচডি গবেষক, তা নিয়ে লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে।
চাকরিতে প্রতারিত হলেন যেভাবে
আশুতোষ লিখেছেন, ‘জীবনে ভুল করা, ঠকা স্বাভাবিক। তবে কিছু ভুল শোধরানো যায় না। আমার জীবনে অনেক ভুল করেছি, ঠকেছি। একদিন স্কুলের ক্লাসে সন্তোষ স্যার বলেছিলেন, “ঠকে, ঠেকে টিকে থাকা মানুষগুলো সফল বেশি।”
‘এবার নিজে ঠকার একটা গল্প বলি। ২০১০ সাল। সদ্য এইচএসসি পাস করেছি। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান হলো না। জীবনের সব স্বপ্ন এক এক করে ভেঙে গিয়েছে। পরিবারটাও ভেঙে গিয়েছে। আমি, বাবা-মা, দাদা—সবাই ভিন্ন জায়গায় যে যার মতো বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। আমি বাঁচার ও নিজেকে তৈরির সংগ্রাম করছি। এ জন্য নিয়মিত সাপ্তাহিক “চাকরির খবর” পত্রিকা কিনতাম আর আবেদন করতাম। বেঁচে থাকার জন্য একটি চাকরি। পড়ালেখাটা যদি চালানো যায়! কত বড় বোকা আমি। গ্রামীণফোন টাওয়ারের চাকরি। বেতন ২০ হাজার টাকা। যোগ্যতা এইচএসসি পাস। যথাসময়ে আবেদন করলাম। এবার খুশির খবর—ফোন করল, আমার চাকরি হয়ে গেছে। ঢাকার বাড্ডায় গিয়ে ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে নিয়োগপত্র নিয়ে আসতে হবে। আমি তো মহাখুশি। টিউশনির টাকা আর আমার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চার দিন পর ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমার প্রথম ঢাকায় যাওয়া ২০১০ সালে। চট্টগ্রামের জিইসি মোড় থেকে বাসে উঠে বাড্ডায় নামলাম। সারা রাস্তায় চাকরির স্বপ্ন দেখতে দেখতে গেলাম, আর মাসের বেতনের হিসাব করেছি—কোথায় কত টাকা খরচ করব? কত সেভিং রাখব? আহা, স্বপ্ন!’আশুতোষ বাড্ডায় নামার পর ফোন দেন ওই নম্বরে। এক লোক তাঁকে নিতে এলেন। সকালের নাশতা সেরে তাঁর অফিসে গিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে চাকরির আশায় ১০ হাজার টাকা দিলেন আশুতোষ। তাঁর সঙ্গে অনেক কথা—কখন, কীভাবে কাজ শুরু করবেন, আর কত অফার।
আশুতোষ বলেন, ‘যা হোক, সেই গল্প আরেক দিন (চাকরির ফাঁদে ফেলার গল্প)। দোতলায় টাকা দিয়ে নিচে এসে বুঝতে পারলাম, আমার ১০ হাজার টাকা শেষ। দেওয়ার আগে বুঝতে পারিনি। কেমনে বুঝতে পারলাম? বুঝলাম, এভাবে কখনো চাকরি হয় না। কিন্তু টাকা তো দিয়েই দিলাম। আবার গিয়ে যদি খুঁজি, তাহলে হয়তো আমার জানটাও যাবে। যে চিপায় অফিস বানাইছে। আমারে দুই সেকেন্ডে গায়েব করে দিতে পারবে। যা হোক, এই হলো ঠকার গল্প। এ রকম আমার জীবনে আরও অনেক ছোট ছোট ঠকার গল্প আছে। প্যারামেডিকেলের চিকিৎসক হতে গিয়ে ঠকেছি। গ্রাম্য চিকিৎসক হতে গিয়ে ঠকেছি। পড়াতে গিয়ে ঠকেছি। ঠকতে ঠকতে এই পর্যন্ত। ইচ্ছা আছে, সামনে আরও ঠকব আর ঠেকব।’আশুতোষ নাথের জন্ম চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির এক প্রত্যন্ত গ্রামে। কিন্তু সেখানে জীবনসংগ্রামে টিকতে না পেরে বাবা মিলন নাথ পাড়ি জমান খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে। সেখানেও জীবন সহজ ছিল না। একটা ভ্রাম্যমাণ ধানভাঙা মেশিন নিয়ে ঘুরে ঘুরে যা আয় হতো, সেটুকুই ছিল সম্বল।
সংসারে পাঁচ সন্তান। আশুতোষ সবার ছোট। তাঁর আগের এক ভাই ও তিন বোনের কেউই উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। সবার ছোট আশুতোষের ওপর বাড়তি ভালোবাসা ছিল বড় ভাই পরিতোষ নাথের। জামা সেলাইয়ের কাজ করতেন তিনি। আয়ের একটা বড় অংশই ব্যয় করতেন আশুতোষের পড়ালেখার পেছনে।
কখনো বাবা, কখনো ভাইকে কাজে সাহায্য করতে গিয়ে পড়াশোনায় মন দিতে পারেননি। তবু ভালো কিছু করার তাগিদ থেকেই মানিকছড়ির রানী নিহার দেবী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে জিপিএ-৪.১৯ আর মানিকছড়ি গিড়ী মৈত্রী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৪.৫০ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেন।
চট্টগ্রামের সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজে রসায়ন বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হলেন। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় ২০১৪ সালে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরির জন্য আবেদন করেন। ২০১৬ সালে এই চাকরি পেয়ে চলে আসেন ঢাকায়। যা বেতন পান, তা দিয়ে সংসার চলে না। রাত জেগে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন তিনি। কেননা, কম্পিউটারে দরকারি দক্ষতা ছিল তাঁর।
আশুতোষ বলেন, ‘ছাত্রাবস্থায় এসব কাজ শিখেছিলাম। ২০১৮ সালেই আমি এ কাজ করে দুই লাখ টাকার বেশি আয় করি। কাজের পাশাপাশি পড়াশোনাও চলতে থাকে।’
স্নাতকে ৩.১৬ সিজিপিএ নিয়ে পাস করেন। স্বপ্ন ডানা মেলে। ঠিক করলেন, ঢাকা কলেজে রসায়নে স্নাতকোত্তর করবেন। ভর্তি হয়ে তিন দিন ক্লাসও করেছিলেন। এ সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) রসায়নে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো। ভাবলেন, একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক। চেষ্টায় সুফল মিলল। ভাইভা দিয়ে বুয়েটে সুযোগ পেয়ে গেলেন আশুতোষ। ক্যাম্পাসটা অফিসের পাশে হওয়ায় পড়ালেখাতেও সুবিধা হয়েছিল। ৩.০৮ সিজিপিএ নিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি।
বুয়েটে পড়ার সময়ই মূলত গবেষণায় আশুতোষের ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। এ সময় আন্তর্জাতিক তিনটি জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। আশপাশের সবাইকে তখন দেখছেন বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে। আশুতোষ এবার নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক করে আবেদন করা শুরু করেন বিশ্বের নানা প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বছরের মার্চের শেষ দিকে বোস্টনের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস তাঁর কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে কয়েক দফায় ভার্চ্যুয়াল ভাইভা নিয়ে পিএইচডি গবেষক হিসেবে আবেদন গ্রহণ করে।