রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত একজন কাজের লোক ছিলো, তাঁর নাম বনমালী।
সেই বনমালী ‘বাবামশাই’ বলে ডাকতেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করতে এক ভদ্রমহিলা আসলেন। বনমালী তাকে বসতে বললেন।
ভদ্রমহিলা বনমালীকে জিজ্ঞেস করলেন-
” কবিগুরু কি বাড়িতে নাই?”
বনমালী বললেন-
” বাবামশাই বাড়িতেই আছেন, কিন্তু ব্যস্ত এখন। আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।”
কবিগুরুর ব্যস্ত থাকাটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা – এটা বুঝে ভদ্রমহিলা বললেন-
” কবিগুরু কি লেখালেখি করছেন?”
বনমালী বললেন-
” না, স্নান করছেন।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নান চলাকালীন সময়ে বনমালীর সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা হলো ভদ্রমহিলার।
ভদ্রমহিলা খুব আগ্রহ নিয়ে বনমালীকে জিজ্ঞেস করলেন-
” কবিগুরুর সাথে আপনার সম্পর্ক কি রকম? কথাবার্তা বলেন আপনার সাথে?”
বনমালী কিছুটা আক্ষেপের সাথে বললেন-
” না, বাবামশাই আমার সাথে কথা বলেন না খুব একটা। কোন কাজ করতেও বলেন না। আমি নিজে থেকেই বুঝি কখন কি লাগবে উনার।”
ভদ্রমহিলা বেশ অবাক হয়ে বললেন-
” উনি আপনাকে নিজের প্রয়োজনে ডাকেন না?”
বনমালী বললেন-
” লেখালেখি করার সময় মাঝেমধ্যে ডাকেন।”
ভদ্রমহিলার আগ্রহের শেষ নাই, প্রশ্ন করলেন-
” কি বলে ডাকেন?”
বনমালী বললেন-
” বনমালী চাকর।”
ভদ্রমহিলা ভুল শুনলেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্ন করলেন-
” বনমালী চাকর? উনি আপনাকে বনমালী চাকর বলেন?”
বনমালী হ্যাঁ সূচক সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়লেন।
ভদ্রমহিলা খুব হতাশ হলেন। এতো বড়ো একজন কবি কিভাবে একজন গৃহকর্মীকে চাকর বলতে পারেন? রবীন্দ্রনাথের মানসিকতা এতো নিচু?
ভদ্রমহিলা এরকম ভাবতে ভাবতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চলে আসলেন।
ভদ্রমহিলার ইচ্ছে ছিলো কবিগুরুর পায়ে হাত রেখে প্রণাম করবেন, কিন্তু সেই ইচ্ছেটা আর জীবিত নাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভদ্রমহিলাকে বললেন-
” দুঃখিত, আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। ভালো আছেন? আসতে কোন অসুবিধা হয় নি তো?
ভদ্রমহিলা বললেন-
” আসতে কোন অসুবিধা হয় নি, আশা করি যেতেও কোন অসুবিধা হবে না। আমি আপনাকে বিরক্ত করবো না। শুধু একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে।”
রবীন্দ্রনাথ বললেন-
” হ্যাঁ, করুন। উত্তর জানা থাকলে আমি উত্তর দিবো।”
ভদ্রমহিলা রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করলেন-
” আপনি বনমালীকে চাকর বলেন কেনো?”
রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন শুনে হেসে দিলেন।
ভদ্রমহিলা বিরক্ত হয়ে বললেন-
” না হেসে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন। আপনি বনমালীকে চাকর বলেন কেনো?”
রবীন্দ্রনাথ হাসি থামিয়ে বললেন-
” চা খেতে ইচ্ছে করলে কি আমি তাকে ‘চা কর’ বলবো না? সে খুব ভালো চা বানায়। খাবেন আপনি?
ভদ্রমহিলা কিছুটা বিব্রত হয়ে গেলেন, খানিকটা লজ্জাও পেলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গলার স্বর মৃদু উঁচু করে বললেন,
” বনমালী, চা কর।”
#আমরা অধিকাংশই কবিগুরুর ওই ভদ্রমহিলার মতো।
আধাআধুরা কথা শুনি,
ভাবার্থ কিংবা মর্মার্থ খুঁজি বা বুঝি তারও কম।
আর প্রচার করি নিজের সাধ্যেরও অধিক।
হোক না তা মিথ্যা কিংবা বানোয়াট।
তাতে কি,
প্রচার করা চাই।
যেনো প্রচার করতে পারলেই প্রশান্তি,
যদিওবা কারো অশান্তির কারণ হই
তবু থেমে নেই আমরা।
কবিগুরুর ভদ্রমহিলার ভুল ধারণা দ্রুতই ভেঙেছে, কিন্তু আমাদের ভুল ধারণাগুলো কখনোই ভাঙে না
কিংবা আমরা ভাঙাতে চাই না।