জেনারালাইজেশন - বাংলায় যেটাকে বলে সাধারণীকরণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা জেনে হোক বা না জেনে, কমবেশি জেনারালাইজ করেই ফেলি। এবং নিজেরা এমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকি যে, লম্বা একটা সময় পর্যন্ত আমাদের এই বোধোদয়ই ঘটে না যে আমরা জেনারালাইজেশনের দোষে দুষ্ট।
তবে এক্ষেত্রে অন্যকে দোষারোপ করার বদলে নিজের উদাহরণই বরং দেয়া যাক।
ক্লাব ফুটবলে আমি বার্সেলোনার সমর্থক। তাই স্বাভাবিকভাবেই রিয়াল মাদ্রিদ হলো আমার রাইভাল দল। এবং অন্য সবার মতোই, ফেসবুকে বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ রেষারেষিতে আমিও শামিল হই। নানাভাবে নিজের দলকে বড় ও বিপক্ষ দলকে ছোট করার চেষ্টায় মত্ত থাকি। এমনটা করতে গিয়ে আমার কাছে শুরুতে মনে হতো, রিয়াল মাদ্রিদের ভক্তরা সবাই খুব বাজে, খারাপ। কেননা তারা তো বিভিন্ন কুযুক্তি দেয়। অকারণে বার্সেলোনা ও মেসিকে নিয়ে ট্রল করে। সুতরাং তাদের চেয়ে বাজে ফ্যানবেজ আর হতেই পারে না। অপরদিকে আমার নিজে দল বার্সেলোনার সব সমর্থককেই আমার মনে হতো ধোয়া তুলসি পাতা। বলাই বাহুল্য, নিজেকেও আমি সেই দলেই ফেলতাম!
এই ভাবনা থেকে, অনেকদিন আমি অবান্তর আত্মতৃপ্তিতে ভুগতাম, আর গোটা রিয়াল মাদ্রিদ ফ্যানবেজকে ঘৃণা করতাম। কিন্তু একটা সময় পর আমি বুঝতে পারলাম, আসলে আমার ধারণা একেবারেই ভুল। মোটেই সব বার্সেলোনা ভক্ত ভালো আর সব রিয়াল মাদ্রিদ ভক্ত খারাপ নয়। প্রকৃত সত্যটা হলো, ভালো ভক্ত যেমন দুই দলেরই আছে, খারাপ ভক্তও তেমন দুই দলেরই আছে। কিন্তু আমি একটি নির্দিষ্ট দলের ভক্ত হওয়া, সেই দলের সব ভক্তের প্রতি আমি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। আর অন্য দলটিকে আমার অপছন্দ হওয়া, সেই দলের সব সমর্থকের প্রতিই আমার গভীর বিরাগ ছিল।
এরকম পক্ষপাতিত্বজনিত ভুল ধারণার বশবর্তী কিন্তু আমরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের জীবনে থাকি। যাকে আমাদের ভালো লাগে, তার একটি ভালো কোনো কাজ দেখেই আমরা ধরে নিই, তার সব কাজই বোধহয় ভালো। আবার যাকে আমাদের খারাপ লাগে, তার ন্যূনতম কোনো ভুল চোখে পড়লেই আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই, ওই লোকের সবই খারাপ।
মূলত মানুষ হিসেবে এটা আমাদের একটা বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা। আমরা অনেক বেশি জাজমেন্টাল, সবসময় সবাইকে জাজ করতে থাকি ঠিকই, কিন্তু সেক্ষেত্রে সামগ্রিক বিচার আমরা করি না। যে কারো ব্যাপারে কোনো নির্ভুল মনোভাব গড়ে তুলতে গেলে তার সকল কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা ও সেগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কিন্তু সেই সময় কোথায় আমাদের হাতে!আমরা একবারের দেখাতেই একটা মানুষের সারাজীবনের আমলনামার হিসাব করে ফেলতে চাই। একটা লোক হয়তো সবসময় সঠিক কথা বলে। একদিন তাকে ভুল বলতে দেখেই আমরা ধরে নিই, ওই লোক কেবল ভুল কথাই বলে। আবার সর্বক্ষণ ভুল বকতে থাকা লোকটিকে একবার সঠিক বলতে দেখেও তাকে সাধুসন্ত ভাবার মতো ভুল করে বসি অনেকে।
এভাবেই জেনারালাইজেশনের ফলে ক্রমশ আমাদের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি লোপ পেতে থাকে। আমরা গভীরভাবে বা তলিয়ে কোনো ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কে ভাবি না। ফলে অন্যরা যেমন আমাদের ভুল ধারণার শিকার হয়, তেমনই কারো ব্যাপারে ভুল ধারণার অধিকারী হওয়ায় আমাদের নিজেদের ক্ষতিও কোনো অংশে কম হয় না।তাই ঠিক যখন থেকে আমরা বুঝতে পারব যে কোনো বিষয়ে জেনারালাইজ করা হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন থেকেই আমাদের সাবধান হয়ে যেতে হবে, জেনারালাইজ করা থেকে বিরক্ত হতে হবে। এভাবেই আমরা পারব একটি ইতিবাচক ও নিখুঁত জীবন গড়তে।