ঢাকায় যানজট নিয়ে কোনো আলোচনা উঠলেই, অনেকেই আছেন, যাঁরা স্কুল-কলেজ খোলাকে দায়ী করেন। তাঁদের কথা ও আলোচনা শুনলে মনে হয়, এই শহরে শোচনীয় যানজটের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই প্রধানতম কারণ।
করোনাকালে দুই বছর দেশে লেখাপড়া প্রায় বন্ধ ছিল। বিকল্প পদ্ধতিতে পাঠদান শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই গ্রহণ করতে পারেনি তাদের সীমিত আর্থিক সামর্থ্যের কারণে। অনেক স্কুলে পরীক্ষা ছাড়াই প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। ঢাকার কোনো কোনো স্কুল শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র তুলে দিয়েছে অবলীলায়। আর শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে গাইড বই খুলে, ইউটিউব দেখে উত্তরপত্র ভরিয়ে দিয়েছে। এর ভিত্তিতেই শিক্ষকেরা করেছেন মূল্যায়ন। লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যাওয়ায় ছেলে-মেয়েদের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, তা আমরা একসময় ঠিকই অনুধাবন করব। কারণ, ক্ষত নিরাময়ের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
করোনাকালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ছিল একটি। মহামারিকাল শেষে চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চের ধুলো-ময়লা ঝেড়ে আবার স্কুলের ঘণ্টা বাজা শুরু হয়েছে। আবার দৌড়ে স্কুলে যাচ্ছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। আর এ অবস্থায় যাঁরা যানজট নিয়ন্ত্রণে পাঠদানের সময় কমিয়ে আনাসহ নানা পরামর্শ আকার-ইঙ্গিতে দিচ্ছেন, তাঁরা যে কত বড় আত্মঘাতী কথা বলছেন, তা যেন আমাদের নীতিনির্ধারকেরা একটু বোঝার চেষ্টা করেন। কোনোভাবেই স্কুল বন্ধ বা পাঠদানের সময় কমিয়ে আনার সুযোগ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দিয়ে কীভাবে যানজট পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়, সেই চিন্তা আমাদের করতে হবে। দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাতাদের আর কোনো ক্ষতির মুখে আমরা যেন না ফেলি।
আমরা বাঙালিরা কাজের থেকে কথা বলতে বেশি পছন্দ করি। কুসুমকুমারী দাশ প্রায় শত বছর আগে লিখে গেছেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ সম্ভবত ঢাকা শহরের যানজট নিয়ে আমরা যত কথা বলেছি, যত আলোচনা করেছি, তা যদি একটি কাগজে লেখা হয়, তবে সে কাগজ দিয়ে হয়তো ভারত মহাসাগরকে মুড়ে দেওয়া যাবে।
আলোচনা ও সুপারিশ যা এসেছে, তার কোনোটাই অগুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু তা যদি সামান্যও বাস্তবায়ন হতো! হয় না বলেই প্রতিদিন সেই একই পাণ্ডুলিপি। যে উড়ালসড়ক দিয়ে সাঁই সাঁই বেগে গাড়ি চলার কথা, সেই উড়ালসড়ক যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব তিন চাকা, চার চাকার যানকে বুকে নিয়ে হাঁস-ফাঁস করছে। তাই যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট যেতে দুই ঘণ্টা, উত্তরা থেকে কারওয়ান বাজার পৌঁছাতে কমসে কম তিন ঘণ্টা। যানজটে আটকে বারবার ঘড়ির দিকে তাকানো, আর কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্টের প্রতি ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ! ঠিকই তো, গন্তব্যে পৌঁছাতে মানুষ আর কত আগে রওনা দেবে! এই শহরে যানজটের কোনো শুক্র, শনি নেই। ছুটির দিনগুলোতে ভালো মন নিয়ে ঘর থেকে বের হয় মানুষ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে সঠিক সময়ে পৌঁছানোর আশায়, হঠাৎ যানজট এসে হাজির হয় নাকের ডগায়। যানজটের কোনো ছুটিছাটা নেই, ডে-অফ নেই।
এই শহরে যানজটের বড় শিকার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কারণ, চাকরি বা কাজ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তাদের ঘর থেকে বেরোতেই হয়। যানজটের ছুরি এই শ্রেণির মানুষকেই বেশি রক্তাক্ত করছে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে।
২.
যানজট নিয়ন্ত্রণে কম আলোচিত একটি বিষয়ের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চাই। তা হলো, অফিসের সময়সূচি ব্যবস্থাপনা। সরকারি, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের অফিসের সময় কেন ৯টা থেকে ৫টা হতে হবে, মোটেই বোধগম্য নয়। লাখো কর্মকর্তা-কর্মচারী সকাল ৯টায় অফিস ধরতে ঘর থেকে বের হন বলেই শহরে কেয়ামত শুরু হয়ে যায়। ঠিক যেমন হয় সন্ধ্যার সময়। গণপরিবহনে সিটে বসা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গাও থাকে না। সবচেয়ে নিগ্রহ হতে হয় অফিস ফেরতা নারীদের। এই শহরে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে কয়টা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ‘পিক অ্যান্ড ড্রপ’ সেবা আছে?
২৪ ঘণ্টায় এক দিন। এর মধ্যে আট ঘণ্টা অফিস টাইম। এই আট ঘণ্টা সময় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে শুরু ও শেষ হতে পারে এবং তা হওয়া দরকার। পরিচিত এক কর্মকর্তা, যিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সকাল সাতটায় অফিস শুরু করেন। বেলা ১১টার মধ্যে তাঁর কাজকর্ম প্রায় শেষ হয়ে যায়। এরপর তিনি ডুবে যান ব্যক্তিগত লেখালেখির কাজে।
এ ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের কাজ সকাল সাতটায় শুরু করা, আর নয়টায় শুরু করার মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি? একটা অফিসের সব স্টাফ একসঙ্গে, একই সময়ে দপ্তরে এসে ঘ্যাঁচাঘাচ কাজকর্ম করে আবার সবাই একসঙ্গে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাবেন, এমন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। সরকারি অফিসের কথা বাদ থাক, সব না হলেও অনেক বেসরকারি অফিসই পৃথক সময়সূচি চালু করতে পারে। এতে যানজট তাৎপর্যপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
করোনা মানবজাতিকে বড় ধরনের শিক্ষা দিয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষা হলো, যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে যত দূর সম্ভব খাপ খাইয়ে নেওয়া। যা কখনো মানুষ ভাবেনি, করোনাকালে তাই ভাবতে হয়েছে। ফিজিক্যালি উপস্থিত ছাড়া যে কাজ করা অসম্ভব বলে মনে করা হতো, করোনাকালে তা ঘরে বসে অনলাইনে করা হয়েছে, সাফল্যের সঙ্গে। এখন যানজট পরিস্থিতি মোকাবিলায়, যদি আমাদের সদিচ্ছা থাকে, অফিসের সময়সূচিতে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে।
কি সমস্যা হয়, যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি অংশের কাজ বেলা ৩টায় শুরু হয়ে ১০টা কি ১১টা অবধি চলে? বা রাত নয়টায় অফিস শুরু হয়ে ভোর পাঁচটায় শেষ হয়! অনভ্যস্ততার কারণে প্রথম প্রথম অসুবিধা হতে পারে। মানিয়ে গেলে, মানিয়ে নিলে সব ঠিক।
৩.
আমাদের ছোট্ট এই ঢাকা শহরের মানুষ দুই কোটির ওপরে, ৫১ বছর আগে ১৯৭১ সালে যা ছিল মোটে ৩০ লাখ। বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণে বিশ্বের নিকৃষ্ট শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। এই শহরে গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় সাড়ে ছয় কিলোমিটারের কম। প্রখ্যাত ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার রবার্ট গ্যালাঘারের গবেষণার তথ্যমতে, ২০৩৫ সালে তা হবে সাড়ে ৪ কিলোমিটারের মতো। টোকিও, সাংহাই, মুম্বাইয়ের মতো অভিজাত, চোখধাঁধানো শহরের চেয়েও ঢাকায় জনঘনত্ব বেশি। ইতিহাস ছাড়া এই শহরের বাসিন্দাদের গর্ব করার মতো কিছুই নেই। তাহলে কিসের নেশায়, কিসের আশায় মানুষ কেবল আসছে আর আসছে?
কিছুদিন আগে ঢাকার উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম জোড়-বিজোড় তত্ত্ব হাজির করেছেন। আজ যদি জোড় নম্বর প্লেটের গাড়ি চলে, কাল তবে বিজোড় নম্বর প্লেটের গাড়ি। এর আগে দিল্লিসহ বিশ্বের কিছু শহরে এই পদ্ধতির প্রয়োগ হয়েছে। কথা হলো, প্রস্তাবটি উত্তম, কিন্তু গাড়ির মালিকেরা মানবে কি? তদারকি করবে কে? আর এ দেশের ধনী লোকদের পক্ষে জোড়-বিজোড় দুটো নম্বরের গাড়ি মেনটেইন করা কঠিন কি!
সপ্তাহের একদিন একটি নির্দিষ্ট এলাকার বিপণিবিতান বন্ধ রাখার অনুশীলন কিছু কিছু চালু হয়েছিল, যা অনেক স্থানে এখনো বলবৎ আছে, বাতি নিভে যাওয়ার মতো করে। কিন্তু চিকিৎসকের চেম্বার খোলা রেখে বিপণিবিতান বন্ধ করলে ফল মিলবে কি?
এলাকাভিত্তিক স্কুলের ব্যবস্থা করাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ রকম ব্যবস্থা চালু আছে। যার বাসা শনির আখড়া, সে যেন মোহাম্মদপুরের স্কুলে পড়তে না যায়। আর ধনী পরিবারের সন্তানেরা যদি স্কুলে গাড়ি নিয়ে না আসে, সবচেয়ে ভালো হয়। বড় স্কুলগুলো নিজেরা উন্নতমানের পরিবহনের ব্যবস্থা করে না কেন?
শহরে অবৈধ পার্কিং যানজটের অন্যতম কারণ। কিন্তু এই শহরে কয়টা ভবনে নিজস্ব পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে? যানজটের কারণ ছোট গাড়ি— ব্যক্তিগত গাড়ি ও মিনিবাস। একটা ব্যক্তিগত গাড়িতে একজন বা দুজন বসে আছেন। হয়তো সেখানে চারজনের বসার জায়গা আছে। আমাদের একজন শিক্ষক একবার এ রকম একটা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ব্যক্তিগত গাড়িতে কোনো সিট ফাঁকা থাকতে পারবে না। কিন্তু কেউ মানেনি। হয়তো না মানার যুক্তিই বেশি শক্তিশালী।
আমাদের দরকার, মিনিবাসের বদলে ডাবল ডেকার বাস। এবং অতি অবশ্যই বিপুলসংখ্যক এসি বাস। যার সামর্থ্য আছে, তিনি এসি বাসে চড়বেন। তেমন হলে অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি বের না করে এসি বাসে চলাচলে অভ্যাস গড়ে তুলবেন। অপর দিকে বনানী, গুলশান এলাকায় ইতিমধ্যে চক্রাকার বাসসেবা চালু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর, শংকর, শাহবাগ হয়ে কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটে একক কোম্পানির বাস চলছে। যেখানে নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বাসে উঠছেন যাত্রীরা। যাকে বলা হচ্ছে নগর পরিবহন। এরপর অন্যান্য রুটেও তা হতে পারে। কিন্তু যানজট তো কমছে না। এ জন্য সবার আগে দরকার একটি চমৎকার ও সমন্বিত নগর পরিবহনব্যবস্থা।
ঢাকাকে এখানে ফেলে রেখে আমরা আমাদের রাজধানী সরিয়ে নিতে পারব না। কারণ, আমাদের জায়গা নেই, আর রয়েছে অর্থের অভাব। ঢাকাকে রাজধানী রেখেই পরিকল্পনা করতে হবে। তিলোত্তমা নগরী না হোক, যানজট সহনীয় মাত্রায় এনে একে বাসযোগ্য তো করতে হবে।
পৃথক অফিস সময়সূচি চালু করা একটি বিকল্প হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা নিজেরা বসে বিষয়টি ভাবতে পারেন, আদৌ কিছু করার সুযোগ আছে কি না, বা কতটা আছে?
আমার মনে হয় সুযোগ আছে।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক।
ই-মেইল: [email protected]