১. বিখ্যাত পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের পরবর্তী সিনেমার নাম হচ্ছে ওপেনহাইমার। আর এই সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করছেন জনপ্রিয় অভিনেতা সিলিয়ান মারফি ও এমিলি ব্লান্ট। ‘ওপেনহাইমার’ সিনেমাটি ২০২৩ সালের ২১শে জুলাই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে যাচ্ছে।
২. ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া জে.রর্বাট ওপেনহেইমার ছিলেন পচন্ড মেধাবী। তাঁর পিতা জুলিয়াস ওপেনহেইমার ১৭ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালে জার্মানী থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমান। মা এলা ফ্রাইডম্যান প্যারিসে পড়াশুনা করেছেন, বিয়ের আগে তিনি ছিলেন আর্টের শিক্ষিকা । পারিবারিকভাবে ওপেনহেইমারের পিতা-মাতা সংগীত, আর্ট পছন্দ করতেন।
১৯২২ সালে ওপেনহেইমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমেস্ট্রিতে ভর্তি হোন। কিন্তু শিঘ্রই ফিজিক্সে চলে আসেন। হাভার্ডে পড়ার সময় রর্বাট বিখ্যাত অধ্যাপক পার্সি ডাব্লিউ ব্রিজম্যান দারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হোন। পড়াশুনায় কে আরও ভাল করে জানার নেশায় ল্যাটিন ও গ্রিকভাষা আয়ত্ব করেন। এছাড়াও ওয়েস্টান, চাইনিজ, হিন্দু ফিলসফিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ওপেনহেইমার পরীক্ষায় ৯৫% এর উপর নাম্বার নিয়ে চার বছরের কোর্স ৩ বছরেই শেষ করে ‘SOMMA CUM LAUDE’ সনদ পান।
এর পর পাড়ি জমান ফিজিক্স এর প্রাণভূমি ইউরোপে। ১৯২৫-২৬ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করেন। এসময়ে কোয়ান্টামতত্ত্বের ওপর ওপেনহেইমারের দুটি মৌলিক প্রবন্ধ ‘জার্নাল অব দ্যা ক্যামব্রিজ ফিলোসোফিক্যাল সোসাইটিতে’ প্রকাশিত হয়। এসময় অনেকে তাঁকে ‘বিস্ময় বালক’ নামে ডাকা হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে ওপেনহেইমার মোট ১৬ টি পেপার বের করতে সমর্থন হোন এবং ১৯২৭ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিচারের সময় জবানবন্দিতে রর্বাট ওপেনহেইমার বলেন-“তিনি কখনো টিভি, পত্রিকা এমনকি ম্যাগাজিনও পড়তেন না। তিনি তাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।” মায়ের মৃত্যুর পর রর্বাট ২২ বছর বয়সী ডাক্তারী পড়ুয়া জিন টাটলকের প্রেমে পড়েন। জিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। সেই সময় জিন নিজের জগতের সাথে রবার্টের পরিচয় করিয়ে দেন। বলা হয়, প্রেমের কারণে রবার্টও একজন কমিউনিজমের সমর্থক হয়ে উঠেন। ১৯৩৪ এ সানফ্রান্সিসকোতে শ্রমিকদের ধর্মঘট ও রাস্তায় হাঙামা সংগঠিত হয়। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে সেই বিদ্রোহে জিন টাটলের সমর্থন ছিল। সর্ম্পকের তিন বছর পর জিনের সাথে রর্বাটের সম্পর্কে ছেদ ঘটে। পরবর্তীতে রবার্ট ওপেনহেইমারের বিচারের ট্রায়ালে তাঁর সাবেক প্রেমিকার সর্ম্পকের ইতিহাসও উপস্থাপিত হয়।
১৯৩৭ সালে ওপেনহেইমারের পিতার মৃত্যু হলে তিনি সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হোন। সমস্ত সম্পত্তি তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উইল করে যান,যাতে এই অর্থ দিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা যায়। এরপর ১৯৪০ সালে ওপেনহেইমার ২৯ বছর বয়সী কিটি হেরিসনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। ওপেনহেইমার ছিলেন কিটির চতুর্থ স্বামী। কিটি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সাবেক সদস্য। বিবাহের সাত মাস পর তাঁদের প্রথম সন্তান পিটারের জন্ম হয়।
হিটলারকে উচিত জবাব দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল লেসলি গ্রোভসকে ‘পারমাণবিক বোমা’ বানানোর নির্দেশ দেন। এবং বিজ্ঞানীদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সাথে সাথে বিষয়টি যেন গোপন থাকে সেই বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়। সেই সময়ে অন্যদের তুলনায় ওপেনহেইমার ছিলেন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। পারমানবিক বোমা তৈরির প্রোজেক্টের নাম দেওয়া হয়-‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’।
জেনারেল লেসলি গ্রোভস ছিলেন বিজ্ঞানী ও প্রোজেক্টকে গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্বে। বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে এই প্রোজেক্টের কোন সংবাদ রাশিয়া কিংবা বাহিরের কোন রাষ্ট্র বা সংগঠনের কাছে যেন না পৌছায় সেজন্য বিজ্ঞানীদের উপরও নজর রাখা হোত। জেনারেল লেসলি গ্রোভস কমিউনিস্টদের ঘৃণা করতেন। ওপেনহেইমারের অনেক বন্ধু যারা ছিলেন যারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তারপরও জেনারেল লেসলি গ্রোভস বিশ্বাস করতেন পারমানবিক বোমা বানানোর জন্য ওপেনহেইমার হলেন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি। ল্যাবরেটরির যারা বোমা বানানোর সাথে জড়িত ছিলেন তাদের সবার উপর গোয়েন্দা নজরদারী করা হতো। সবচেয়ে বেশি নজরে রাখা হতো ওপেনহেইমারকে। তার গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে সবার উপর এফবিআই নজরদারি করতো।
১৯৪৫ সালের ১২ জুলাই, রাত ৪.৩০ মিনিটে পারমানবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালানো হয়। ওপেন হেইমার অনেক ভাষা জানতেন এবং মিথ সম্পর্কেও আগ্রহী ছিলেন। পারমানবিক বোমার দৃশ্য দেখে ওপেনহেইমার তাঁর আশা ও ভয়কে প্রকাশ করেছিলেন ভাগবদ গীতার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে –
“In battle, in the forest, at the precipice in the mountains,
On the dark great sea, in the midst of javelins and arrows,
In sleep, in confusion, in the depths of shame,
The good deeds a man has done before defend him ”
আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল “ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে?” আইনস্টাইনের উত্তর ছিল “ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে জানি না , তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ যে লাঠি এবং পাথর দিয়ে হবে তা বলতে পারি”।” I know not with what weapons World War III will be fought, but World War IV will be fought with sticks and stones.” হিরোশিমা ও নাগাসারিকর অবস্থা দেখে ওপেনহেইমারও ব্যথিত হোন। মারণাস্ত্র তৈরিতে পিছিয়ে ছিল না আরেক পরাশক্তি অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদিকে এডওয়ার্ড টেলর হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য পায় প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছ থেকে। অপরদিকে হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কারের বিরোধিতা করেন ওপেনহেইমার। পারমানবিক বোমার পরিণতি দেখেই তিনি হাইড্রোজেন বোমার বিরোধীতা করেন। কিন্তু এই বিষয়টি ভাল চোখে নেয় নি প্রসিডেন্ট ট্রুম্যান। ফলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয় ওপেনহেইমারের বিরুদ্ধে।
আমেরিকা রাষ্ট্র যখন ওপেনহেইমারকে নিরাপত্তার প্রশ্নে বিচারের সম্মুখিন করা হয় তখন আমেরিকার জনগণের মনে যে প্রশ্নটির উদয় হল; ওপেনহেইমার যদি বিশ্বাসী ব্যক্তি না হয় তাহলে বিশ্বাসী ব্যক্তিটি কে?
আমেরিকার সেই সময় কমিউনিস্ট আতংক বিরাজ করছিল। শুধু ওপেনহেইমার নয় চার্লি চ্যাপলিন কেও কমিউনিস্ট ভাবা হতো। অনেকেই সন্দেহ করতেন চার্লি চ্যাপলিন হয়তো কমিউনিস্ট। আর সে কারণেই হলিউডের ওয়াক অব ফেম থেকে তাঁর পদচিহ্ন নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে তা হারিয়ে যায়। ১৯৪০ সালে নাৎসি শাসনামলে ব্যঙ্গ করে তৈরি ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ হিটলারের ভূমিকায় চ্যাপলিনের অভিনয় বিশ্বজুড়ে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকার শীতলযুদ্ধ যুদ্ধ চলার সময় চার্লি চ্যাপলিনের বামপন্থী মনোভাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে করে আমেরিকা। ১৯২৩ সালে আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টিকে আর্থিক অনুদান দেয়ায় দেশটির সরকারের সন্দেহ আরো জোরদার হয়ে ওঠে। কিন্তু চ্যাপলিন নিজে কখনো তার বামপন্থী যোগাযোগ স্বীকার করেন নি। ১৯৫২ সালে ‘লাইমলাইট’ সিনেমার প্রিমিয়ার শো’তে লন্ডনে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে ফেরার সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার অভিযোগ এনে চ্যাপলিনকে আমেরিকায় প্রবেশের অনুমতি দেননি দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল জেমস ম্যাকগ্রেনারি। আর তখনই চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে এমআই-৫-কে তদন্তের অনুরোধ জানায় আমেরিকা। সেই তদন্তের রিপোর্টই বৃটেনের জাতীয় সংগ্রহশালা (ন্যাশনাল আর্কাইভস) সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। তবে এই বিতর্ককে গুরুত্ব দিতে রাজি নন সাবেক এমআই-৫ প্রধান জন ম্যারিয়ট। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চ্যাপলিন হয়তো বামপন্থী ছিলেন। কিন্তু তার উপস্থিতি কোনো দেশের জন্যই বিপজ্জনক ছিল না।’ তবে বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, চার্লি চ্যাপলিনের নাগরিকত্ব নিয়ে ওঠা বিতর্ক সে সময় আমেরিকা সরকারের বাম-বিদ্বেষ আরো একবার প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। তবে চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন- “মানুষকে ভালোবাসার জন্য যদি আমাকে কমিউনিস্ট হতে হয় তাহলে আমি কমিউনিস্ট।’’
ওপেন হেইমারের ভাই পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ফ্রেইডম্যান ওপেনহেইমার ১৯৮৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কণা পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্পের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৭-৩৯ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাকে ঝামেলায় ফেলে। তিনি ম্যাকার্থিজমের স্বীকার হন। সে সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অব মিনোসোটায় পদার্থ বিজ্ঞানে শিক্ষকতা থেকে অব্যাহতি নেন। কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
এক সময়ের আমেরিকার জাতীয় বীরের বিরুদ্ধে ১৩ বছর ধরে এফবিআই অনেক চেষ্টা করেও ওপেনহেইমার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন এমন কোন প্রমাণ দিতে পারে নি। তবে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাগিরি ও বিচাররের মুখোমুখির কারণে ওপেনহেইমার পারিবারিক জীবনে ধস নামে। স্ত্রী সবকিছু ভুলে থাকার জন্য মদের নেশায় ডুবে থাকতেন। সামাজিক অসম্মান সহ্য করতে না পেরে কন্যা ক্যাথরিন আত্মহত্যা করেন। পুত্রের ভবিষ্যত হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। বিচার চলাকালীন হেইমানকে তার বিভিন্ন পদ থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয় কিন্তু একদল বিজ্ঞানীর প্রতিবাদের মুখে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পরে শুরু হয় আমেরিকার “কমিউনিজম” জুজু ও আতংক। আর সেই আতংকের বলি হোন অনেকেই। জে.রবার্ট ওপেনহেইমার তাদের মধ্যে অন্যতম।
- রবার্ট ওপেনহেইমার -বিস্ময়কর এক প্রতিভার অপমৃত্যু!- সেভেরাস স্নেইপ
- J Robert Oppenheimer biographical memoir by H.A.bethe
- American Experience the Trials of J Robert Oppenheimer PBS Documentary
- মানহাট্টান প্রজেক্ট এবং পারমানবিক বোমার জন্ম। (Manhattan Project and the birth of the Atom Bomb)
- আমেরিকার সন্দেহ থেকে নাগরিকত্ব বিতর্কে চার্লি চ্যাপলিন-যায়যাদিন
- মহামানবিক ভুল অথবা দুঃস্বপ্নের গল্প- সাক্ষী সত্যানন্দ
- সুব্রত শুভ