নিঃস্বার্থ বিজ্ঞান সাধক

in blurtlife •  3 years ago 

আমরা এখন মানুষকে মাপি কত কোটি বিলিয়ন টাকা ডলার কামাতে পারে, তার হিসাবে। তাই কে কোন আইডিয়া বেচে কত টাকার স্টার্টাপ খুলে বসলো, তাকে নিয়েই আমাদের সব জয়জয়কার। কিন্তু এই বিশ্বে কিছু নির্লোভ পাগলাটে লোকও আছে, যারা টাকার জন্য না, বরং মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে, বিলিয়ন ডলার কামিয়ে বিলিয়নিয়ার হওয়ার লোভ ছেড়ে দিতে পারে অনায়াসে।

"সূর্যকে কি কেউ প্যাটেন্ট করে কুক্ষীগত করে রাখতে পারে?"

ইতিহাস জুড়ে শিশুদের পঙ্গুত্বের একটা বড় কারণ ছিলো পোলিও। প্রতিবছর গরমকালে হাজার হাজার শিশু পঙ্গু হয়ে যেতো পোলিওতে। পোলিও হয় একটা খুব ভয়াবহ জীবাণুর কারণে। ১৯৫২ সালের কথাই ধরা যাক, সেবছর কেবল আমেরিকাতেই পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিলো ৫৮ হাজার শিশু, এদের মাঝে মারা যায় ৩ হাজার, আর চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায় ২৮ হাজার শিশু। পোলিও হওয়াটাই ছিলো আজীবন পঙ্গু হয়ে যাবার মতো একটা অভিশাপ। আর কেবল ছোটদের হতো তা না, চার বার আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে যান। রোগটা হলে নানা অঙ্গ অবশ হয়ে যেতো, গুরুতরভাবে হলে নিঃশ্বাস নেয়ার ক্ষমতা লোপ পেতো, আর অল্প করে হলে হাত বা পা হতো পঙ্গু।

কীভাবে এই ভয়াল পোলিওভাইরাসকে ঠেকানো যায়? বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই গবেষণা করছিলেন তা নিয়ে। বিষ দিয়ে বিষক্ষয়ের আইডিয়া অনুযায়ী পোলিওভাইরাসকেই দূর্বল করে টিকা বানাবার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কেউই হচ্ছিলেন না সফল। কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সের এক বিজ্ঞানীর মাথায় খেলে গেলো অন্য একটা আইডিয়া -- জ্যান্ত ভাইরাসের বদলে মৃত ভাইরাস দিয়েই চেষ্টা করা যাক।

বিজ্ঞানীটির নাম, জোনাস সাল্ক।

জোনাস সাল্ক জন্মে ছিলেন নিউইয়র্কেই, অভিবাসী পূর্ব ইউরোপীয় অশিক্ষিত বাবা মায়ের ঘরে। বাবা ছিলেন দর্জি, প্রাথমিকের পর আর পড়েননি। মা ডোরা ছিলেন পুরাপুরি অশিক্ষিত। কিন্তু দুজনেরই ছিলো শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ -- অল্প বয়সেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয় তাঁকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যান মাত্র ১৫ বছর বয়সে। শুরুতে ইচ্ছা ছিলো উকিল হবার, কিন্তু মায়ের ইচ্ছায় ডাক্তারি পড়ায় ভর্তি হন। তবে চিকিৎসা করা তাঁর ইচ্ছা ছিলো না, বরং মন পড়ে থাকতো গবেষণায়। তাই পাস করার পর ডাক্তারি না করে ব্যাক্টেরিয়া ও অন্যান্য রোগজীবাণুর উপরে গবেষণায় লেগে যান। কিন্তু পথটা ছিলো অনেক বন্ধুর -- ইহুদি হবার কারণে তখনকার দিনে নানা ল্যাবে চাকুরি পাননি শুরুতে। তার পর শুরুতে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পরে পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগ পান।

পোলিও তখন মূর্তিমান আতঙ্ক। পোলিওর টিকা বের করার জন্য আড়াই বছর ধরে সাল্ক লেগে থাকেন। নানা জিনিষ ঘেঁটে ভাবলেন মৃত ভাইরাস দিয়ে টিকা বানিয়ে দেখা যাক। যেই ভাবা সেই কাজ, বানালেন টিকা। কিন্তু এটা কি নিরাপদ? কীভাবে বুঝবেন? নিজের উপরেই পরীক্ষা চালালেন টিকার ইঞ্জেকশন দিয়ে। কেবল তাই না, নিজের স্ত্রী আর নিজের সন্তানদেরকেও টিকা দিলেন -- এতোই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন সাল্ক। আস্তে আস্তে সবার কাছে এই টিকার খবরটা গেলো ছড়িয়ে, আর কয়েক লাখ লোকজন নিয়ে ক্লিনিকাল ট্রায়াল করে প্রমাণিত হল এই টিকার কার্যকারিতা। ১৯৫৫ সালে লাইসেন্স পেলো সাল্কের এই পোলিও ভ্যাক্সিন -- আর পোলিও আতঙ্কের ঘটলো অবসান। পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পোলিও নির্মুলকে এক আন্তর্জাতিক আন্দোলনে রূপ দেয়, যার ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বে পোলিও রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা কয়েক লাখ থেকে নেমে আসে মাত্র কয়েকশতে। আজ সারা বিশ্বে পোলিও প্রায় পুরাপুরি নির্মুল করা গেছে। কেবল পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এলাকাগুলোতে এটা আছে, বাকি সব জায়গায় এই পোলিও আর নাই, কারণ একটাই, পোলিওর টিকা।

জোনাস সাল্ক রাতারাতি বনে গেলেন আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিতে, কিন্তু খ্যাতি তিনি চাননি, বরং চেয়েছেন খ্যাতির বিড়ম্বনা বাদ দিয়ে ল্যাবে ফিরে যেতে। আবিষ্কৃত এই পোলিও ভ্যাক্সিনকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে ছাড়লে চড়া দামে নানা কোম্পানি তা বেচতে পারতো, এক মুহূর্তেই জোনাস সাল্ক হয়ে যেতে পারতেন বিলিয়ন ডলারের মালিক।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই বিলিয়ন ডলারকে ডঃ সাল্ক অগ্রাহ্য করলেন, বিনা মূল্যে সবার কাছে, সব শিশুর কাছে পৌছে দেয়ার জন্য এই টিকাটিকে প্যাটেন্ট না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এক হিসাবে দেখা যায়, এটা প্যাটেন্ট করে বাণিজ্যিকভাবে অনেক দামে বিক্রি করলে ডঃ সাল্ক প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের মালিক হতে পারতেন।

৭ বিলিয়ন ডলার মানে কতো টাকা?

২০১৮ এর হিসাবে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। সাত রাজার ধন, তাই না? পায়ে ঠেললেন এই ধনকে জোনাস সাল্ক। অবলীলায়।

যখন সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলো, কেনো কপিরাইট/প্যাটেন্ট করলেন না এই টিকাকে, কেনো পায়ে ঠেললেন এতো টাকাকে, তখন ডঃ সাল্ক বলেন,

কেন করবো? সূর্যের কি প্যাটেন্ট হয়?

এরকম নিঃস্বার্থ বিজ্ঞানীরা আছেন বলেই দুনিয়াটা এতো সুন্দর।

আমরা সবাই ডঃ জোনাস সাল্ক নই, কিন্তু দুনিয়াটার ভালো করার অল্প হলেও ক্ষমতা আমাদের আছে। আপনি আমি আমরা সবাই প্রতিদিনের অল্প একটু সময় একটা ভালো কাজে দিয়ে করতে পারি এই বিশ্বকে নবজাতকের বাসযোগ্য, করতে পারি আমাদের এই দুনিয়াকে অসাধারণ সুন্দর একটি স্থান।

© Ragib Hasan

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE BLURT!