মৃৎশিল্প গ্রামবাংলার একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এ শিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি হওয়ায় একে মৃৎশিল্প বলে। এ শিল্পে প্রয়োজন পরিষ্কার এঁটেল মাটি এবং হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞান। কারিগররা গভীর ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে নিপুণ হাতের কারুকাজের মাধ্যমে তৈরি করেন নানা তৈজসপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী।
বাংলাদেশ রূপ বৈচিত্রের দেশ। এদেশে অতীত কাল থেকেই হাজার ধরনের সংস্কৃতি পালন করা হয়। যার একটি নিদর্শন হলাে মৃৎশিল্প। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। 'মৎ' মানে মাটি আর শিল্প’ মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বস্তু। তাই মাটি দিয়ে তৈরি শিল্পকর্মকে মৃৎশিল্প' বলে, এবং যারা এই শিল্পকর্মের সঙ্গে জরিত তাদের বলা হয় কুমার।
কুমররা অসম্ভব শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানাে সব কাজ করে থাকেন। এই শিল্পটি হল বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প যা বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহন করে।
মাটিই তাদের জীবিকা অর্জনের একমাত্র হাতিয়ার। কালের বিবর্তনে আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি নানা সামগ্রী তৈরি হওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার প্রাচীন এ শিল্পটি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৃৎশিল্পের কারিগরদের জীবনযাত্রার মান দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছে। কষ্টকর হয়ে পড়ছে তাদের এ পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করা।
সম্প্রতি খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন যাবৎ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে বেচাকেনা না থাকায় অচল হয়ে পড়েছে মৃৎশিল্পের কয়েকশ পরিবার। তারা বসে আছে হাত-পা গুটিয়ে। মৃৎ কারিগররা জানিয়েছেন, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং
এগুলোর দাম সীমিত থাকায় মাঠির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘদিন যাবৎ কোনো মেলা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মৃৎশিল্পের কারিগররা। পরিবার নিয়ে আর্থিক সংকটে ভুগছেন অসংখ্য কারিগর। জানা যায়, জীবিকার তাগিদে অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য কাজে যোগ দিচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে দেশের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। কেবল তা থেকে যাবে বইয়ের পাতায়।
কালের বিবর্তনে, শিল্পায়নের যুগে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এই মৃৎ শিল্প। বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজের পরিধি পরিবর্তন না করা, কাজে নতুনত্বের অভাব, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্য বৃদ্ধি, কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রী পরিবহনে সমস্যা নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলার বহু বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প।
শুধু তাই নয়, প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা এসব তৈজসপত্রের নানাবিধ সুবিধার কারণে দিন দিন আবেদন হারাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পকর্ম।
কাজেই মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহারে আমাদের নিজেদের আগ্রহী হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও উৎসাহিত করতে হবে। সেই সঙ্গে এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ একান্ত জরুরি। সরকার যদি কুমোর সম্প্রদায়কে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের আর্থিকভাবে কিছু সহায়তা দেয়, তাহলে আশা করা যায় মাটির শিল্পের সোনালি দিন আবার ফিরে আসবে।
এখন বিশেষ বিশেষ সময়ে অনুষ্ঠিত মেলায় দেখা মিলে মাটির এসব তৈজসপত্র। বিশেষ করে বাংলা সালের বিদায় ও বরণ উৎসবে। মেলায় আগতদের হাতে হাতে স্থান পাবে এসব মাটির জিনিস। মঙ্গল শােভাযাত্রায়ও স্থান করে নেয় এগুলাে।
বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় এই শিল্পে অনেকটা ভাটা পড়লেও নতুন করে মৃৎশিল্পের আর একটি শাখা উন্মােচিত হয়েছে। সেটি হলাে নান্দনিক মৎশিল্প।
এ শাখার মৎশল্পীরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন শৌখিনসামগ্রী ও শিল্পকর্ম তৈরি করে থাকেন, ইংরেজিতে একে বলা হয় পটারি শিল্প। এরা টেরাকোটা বা মৃৎফলকে খােদাই করে সুন্দর সুন্দর শােপিস তৈরি করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মূর্তি, অলঙ্কার, নকশি পাত্র, ঘণ্টা ইত্যাদি তৈরি করছেন। ঢাকার অনেক দোকানে এসব শৌখিন মৎসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে।
আমরা সবাই আমাদের এই প্রাচীন শিল্পকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।