অলীক পোকার গপ্পো

in blurt •  3 years ago 

health.jpg

একটি প্রাচীন লেখার অক্ষম আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ করার চেষ্টা করছিলাম ।
লেখাটি পাওয়া গিয়েছে প্রাচীন‌ ব্যাবিলনের একটি স্লেট এ।

হ্যাঁ সেই ব্যাবিলন, যেখানে প্রায় চার হাজার বছর আগে ছিল উন্নত মানব সভ্যতা । ছিল ঝুলন্ত উদ্যান।

লেখাটি কি দাঁড়ালো -

অনু (সেই সময়ের সকল দেবতাদের পূর্বপুরুষ অথবা আকাশ) স্বর্গ সৃষ্টি করলেন।
স্বর্গ , পৃথিবী সৃষ্টি করলেন।
পৃথিবী , নদীর জন্ম দিল ,
নদী , খালের জন্ম দিল।
খাল , হাওড় বিল জলাভূমির জন্ম দিল।
হাওড় বিল জলাভূমি পোকাদের জন্ম দিল !
পোকারা জলাভূমি তে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
তাঁরা বিচারের দেবতা সামাস এর কাছে গেল,
তাঁরা জলের দেবতা ইয়া র সামনে কেঁদে ভাসিয়ে দিল এই বলে -
আমাদের খাবার জন্য কি রেখেছেন?
কি রেখেছেন যা আমরা চুষে খেতে পারি ?
দেবতারা বললেন - এই নাও পাকা ফিগ (এক ধরণের ফল) এবং অ্যাপ্রিকট ।
পোকারা বললো - ওসব দিয়ে কি হবে?
তার চেয়ে আমাদের বাসস্থান করে দিন দাঁত আর মাড়িতে।
আমরা দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত চুষে খাবো ,
আমরা মাড়ির ভেতর দাঁতের গোড়া গুলোকে আস্তে আস্তে চিবোতে থাকবো।

(ভাবুন, পলিটিশিয়ান দের মতো মামা বাড়ির আবদার কত!)

তো এই অনুবাদ থেকে কিছু পেলেন ??
দাঁতের পোকার জন্ম বৃত্তান্ত , তাইতো ??

অপেক্ষা করুন।
আর একটু সামনে পেছনে আসা যাওয়া করুন।

সুমেরীয় সভ্যতা বলে কিছু জানেন ? পাঁচ হাজার বছর আগেকার !

কিংবা পরবর্তী কালের চৈনিক , মিশরীয় , রোমান অথবা মধ্যযুগীয় সভ্যতার কথা জানেন ??

অথবা একসময় আমাদের শাসন ও শোষণ করে যাওয়া ইংল্যান্ডের কথা ?

এই সবগুলো সভ্যাতার মধ্যে মিল কোথায় বলুন তো ??

আসুন, এখনকার শ্রীলঙ্কা মানে প্রাচীন সিংহল এ প্রচলিত কয়েকটি লাইন বলি -

Worm of the sun-god!
Worm of the moon god!
Worm of the Passé Buddha!
Stay not in the tooth, tou tooth-worm!

আচ্ছা থাক, অতদূর যেতে হবে না।
আমাদের এই দেশে ও গ্রামে গঞ্জে বেদেনী রা এক ধরণের গাছের শিকড় দিয়ে আর তুলো দিয়ে দাঁতের পোকা বের করে ফেলে , দেখেছেন কেউ ??

পোকাগুলো যে হাতের তুলোতেই থাকে, সেটা কখনো দেখেছেন??

নাকি অবিশ্বাস্য একটা হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছেন শুধু??

মাথার চুল ছিঁড়ে ও মিল পাবেন না , যদি না আপনি জানেন - এই দীর্ঘ সময় কাল ধরে মানব সভ্যতা বিশ্বাস করেছে - মানুষের দাঁতে পোকা হয় !

আর সেই পোকা - আমাদের দাঁত কালো করে, ক্ষয় করে , গর্ত বানায় !!
যাকে আজকের দিনে caries অথবা cavity বলা হয় !!

কি একটু চকচকে এনামেল সহ দাঁত কেলিয়ে হাসবেন নাকি ??

নাকি পোকা আছে ?

তাহলে আসুন একটু ধোঁয়া দিই আপনার মুখে !
রাগ করলেন ??
দাঁড়ান একটু। মুখ হাঁ করুন!
ভাবুন, আপনি মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ড এ বাস করছেন । আপনার দাঁতে পোকা।
Henbane নামক একটি বিষাক্ত গাছের ফল থেকে বীজ নিয়ে সেটা পুড়িয়ে আপনার মুখে ধোঁয়া দিই!
দেখবেন , সব পোকা দাঁতের গোড়া থেকে কিলবিল কিলবিল করে বেরিয়ে আসবে !!

গা ঘিন ঘিন করছে ??
কেন মশাই ?
আপনি তো প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বাজার গরম করতে বেশ ওস্তাদ !
এখানে সেখানে ন্যাকাকান্না কেঁদে বেড়ান - আহা রে ! পেরাচীন চিকিৎসা কত্তো ভালা ছেল! আমাগো দ্যাশেও কত্তো কত্তো চেকেচ্ছা ছেল!!

বড় বড় গর্ত আছে নাকি দাঁতে ?? ব্যাথা হয় বুঝি ?
বাবা রে মাগো রে বলে পোকাদের জন্য গরম জল লবঙ্গ দিয়ে রাখেন না ??
নিদেনপক্ষে দন্তকান্তি তো ব্যবহার করেন , তাই না ?

ভয় পাবেন কেন??
আধুনিক চিকিৎসকদের কাছে যাবেন কেন ??

তবে হাসবেন । হাসলে শরীর মন ভালো থাকে ।
পেরাচীন চেকেচ্ছা র কেচ্ছা পড়ে ও হাসতে পারেন !!

পোকা আপনার কিছুই করতে পারবে না ।
এটা বিজ্ঞানের গ্যারান্টি !

কারণ, দাঁতের পোকা বলে কিছু হয় না !! অলীক পোকার গপ্পো এসব !!

বিজ্ঞান দেখিয়ে দিয়েছে , পাঁচ হাজার বছরের এই মিথ ভুল !!
লালারস ( লালা রামদেব এর রস নয় কিন্তু!) , অ্যাসিড, এক ধরণের ব্যাকটেরিয়ার মিলিত প্রকল্পের ফলাফল হলো এই গর্ত এবং ক্ষয়রোগ !
মুখ অপরিস্কার রাখার ফলাফল এই রোগ !!

তবে হ্যাঁ, যতই বলি - এই দাঁতের গর্ত বা ক্ষয় হয়ে যাওয়া একজন মানুষের শুধু শারীরিক নয় , মানসিক ক্ষতি ও করে।

আমি নিজেও একসময় ভুগেছি এই রোগে।

একসময় ভাবা হতো - কুয়োর জলের ভেতর থাকা এক ধরনের জীবানু Drucunculus medinensis এই রোগের জন্য দায়ী ।

সেটিও ভুল প্রমাণিত।
তবে কিছুই কি ছিল না এই মিথ তৈরি হবার পেছনে ??

ছিল !

ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যাণ্ড ডেন্টাল স্কুল এর গবেষণা প্রমাণ করেছে - দাঁতের ভেতরে পোকার মতোই দেখতে অনেকগুলো ছোট ছোট জিনিস আছে ! সেগুলো কিন্তু নর্মাল !!

এর আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে পিয়েরে ফাউচার্ড বলে এক মধ্য আমেরিকার গবেষক মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখে বলেছেন - নষ্ট হয়ে যাওয়া দাঁতের পাল্প দেখতে খানিকটা পোকার মতোই !!

অতএব, পোকার মিথ তৈরি কি অসম্ভব ছিল ?
না।

আর এখন , এইসব ইতিহাস পেরিয়ে এসে ডেন্টাল সায়েন্স এতোটাই উন্নত যে , চাইলেই আপনার দাঁতের এনামেল ( যেটা একবার নষ্ট হলে কোন ভগবান অব্দি তৈরি করতে পারে না বা তৈরি করে দেয়নি !) এর হুবহু অন্য রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে ফেলেছে !!

চাইলেই , আপনার গোটা মাড়ির দাঁত আগের মতো দেখতে করে দিতে পারে!

হ্যাঁ , বিজ্ঞান এই গর্ত বুজিয়েছে , ক্ষয় বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে !

অতএব, পেরাচীন চেকেচ্ছা য় কি ছিল কি ছিল না , সে সব না জেনে মিডিয়ার বিজ্ঞাপনী মোহে পড়ে নিজের দাঁত নষ্ট হতে দেবেন না !

কিছু পোকা এখনো আছে আমাদের সভ্যতায় , যারা মোটেই দাঁতের পোকার মতো অলীক নয় !
বরং রক্ত মাংসের বাস্তব মানুষের মতোই দেখতে !!

একটু সাবধান হোন। বিজ্ঞান যদি আপনার ক্ষতি করতো , তাহলে আপনি পড়ে থাকতেন ওইসব প্রাচীন সভ্যতায়।

যাকগে । এবার একটুখানি কবিতায় ফিরে আসি ।

জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়েছেন তো ??
আবার পড়ুন লাইন গুলো -

... পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল;-/এশিরিয়া ধুলো আজ-ব্যাবিলন ছাই হ’য়ে আছে’।

অথবা এটা -

... চোখ বুজে একপাশে সরে যাই-গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা
উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানি নাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।

আপনি কিন্তু চাইলেই জানতে পারেন -
জীর্ণ পাতা কেন ঝড়ে যায় , কেন হাজার হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা থেকে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ আজকের সভ্যতায় এসে পৌঁছেছে ।

কে এনেছিল কবিকে এই আজকের মনুমেন্ট আর তারা ভরা কলকাতায় ??

বিজ্ঞান !
আপনি ব্যাবলিনের ঝুলন্ত উদ্যানে কিংবা সুমেরু সভ্যতার দেবতাদের সঙ্গে সগ্গীয় আয়েশ ভোগ করতে চাইলে করুন না !!

খালি দাঁত কেলাবেন না! পোকা দেখা যাবে !! গর্ত দেখা যাবে - দাঁতে আর মগজে !!

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE BLURT!