মৌলিক বল (Fundamental Forces)
প্রকৃতিতে আমরা বিভিন্ন বল বা ফোর্সের দেখতে পাই। এদের মধ্যে সব বলই কিন্তু মৌলিক বল নয়। মৌলিক শব্দের অর্থ বলতে সাধারণত বোঝায় স্বাধীন এবং অনন্য বা নিরপেক্ষ। খুব সাধারণভাবে যদি বলা হয়, মৌলিক বল হচ্ছে মূল বা স্বাধীন বল অর্থাৎ যে সকল বল অন্য কোন বল থেকে উৎপন্ন হয় না বা অন্য কোন বলের রূপ নয় বরং অন্যান্য সকল বল এর থেকে উৎপন্ন হয় কিংবা এসব বলের রূপান্তর মাত্র তাদেরকে মৌলিক বল বলে। প্রকৃতিতে বিদ্যমান চারটি মৌলিক বলকে দুর্বলতার অনুক্রমে সাজালে আমরা পাই-
১. মহাকর্ষ বল ।
২. দুর্বল নিউক্লিয় বল ।
৩. তড়িৎ চৌম্বক বল ।
৪. সবল নিউক্লিয় বল ।
মহাকর্ষ বল:- মৌলিক বলগুলোর মধ্যে মহাকর্ষ বল সবচেয়ে দূর্বল।মহাকর্ষ হলো মহাবিশ্বের যেকোনো দুইটি বস্তুর মধ্যকার আকর্ষণ বল। এই বলের পাল্লা অসীম পর্যন্ত হয়ে থাকে, কিন্তু মহাকর্ষ বল অত্যন্ত দুর্বল বল। গ্রাভিটন নামক কণার পারস্পরিক বিনিময়ের জন্য দুই বস্তুর মধ্যে এই বল কার্যকর হয়। মহাকর্ষ বল মাধ্যমের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে না। মহাকর্ষ বলের মান ক্রিয়াশীল বস্তু দুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক ও এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক এবং এই বলের দিক বস্তুদ্বয়ের সংযোজক সরলরেখা বরাবর। নক্ষত্র, গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রপুঞ্জ গঠনে মহাকর্ষ বল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মহাকর্ষ বল নক্ষত্রগুলোকে একত্র করে গ্যালাক্সি গঠন করে।
তড়িৎচুম্বকীয় বল:- দুটি আহিত বা চার্জড বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলকে তড়িৎ চৌম্বক বল বলে। এই বল আকর্ষণী বা বিকর্ষণী প্রকৃতির হতে পারে। এটাও দুর্বল বল এবং এর পাল্লা অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। কার্যকারিতা পরিমাপে তড়িৎচুম্বকীয় বল দুর্বল হলেও, মহাকর্ষ বলের তুলনায় এটা অনেক সবল। প্রকৃতির অধিকাংশ বলই তড়িৎচুম্বকীয় বলের গোত্রভুক্ত। ঘর্ষণ বল, কুলম্বের তড়িৎ বল, কুলম্বের চৌম্বক বল, স্থিতিস্থাপক বল বা স্প্রিং বল, পরমাণুতে কার্যরত নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের মধ্যকার পারমাণবিক বল ইত্যাদি তড়িৎচুম্বকীয় বল। ভরহীন ও চার্জহীন ফোটন নামে কণার পারস্পরিক বিনিময়ের জন্য এই বল কার্যকর হয়। এই বল বস্তুর আণবিক গঠন ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য দায়ী থাকে। ইলেকট্রনকে নিউক্লিয়াসের সাথে আবদ্ধ করে পরমাণু গঠন করে তড়িৎচুম্বকীয় বল। তাই বলা যায়, অণু-পরমাণুর গঠন, রাসায়নিক বিক্রিয়া, পদার্থের তাপীয় ও অন্যান্য ধর্ম তড়িৎচুম্বকীয় বলের ফল।
সবল নিউক্লীয় বল:- এটি হচ্ছে সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী বল। তড়িৎচুম্বকীয় বল থেকে যা একশগুণ বেশি শক্তিশালী কিন্তু এটি খুবই অল্প দূরত্বে কাজ করে। যে বল নিউক্লিয়াসের সীমানার মধ্যে নিউক্লিয়নসমূহকে (যেমন—প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি) দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে স্থায়ী নিউক্লিয়াস গঠন করে, তাকে সবল নিউক্লিয় বল বলে, তবে এটি খুবই স্বল্প পাল্লার বল। নিউক্লিয়াসের সীমানার বাইরে এই বলের কোনো প্রভাব নেই। সবগুলো মৌলিক বলের মধ্যে এই বল সবচেয়ে শক্তিশালী। মেসন বা গ্লুঅন নামে কণার পারস্পরিক বিনিময়ের জন্য এই বল কার্যকর হয়। এর পাল্লা 10-15 m যা নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধের সমান। দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে এই বল দ্রুত হ্রাস পায়। এই বল চার্জ নিরপেক্ষ। সবল নিউক্লিয় বল প্রোটন ও নিউট্রনকে একত্রে আবদ্ধ করে নিউক্লিয়াস গঠন করে। এই বল সমভাবে প্রোটন-প্রোটন, নিউট্রন-নিউট্রন এবং প্রোটন-নিউট্রনের মধ্যে কার্যকর। উল্লেখ্য, ইলেকট্রনের মধ্যে কোনো সবল নিউক্লিয় বল নেই।
দুর্বল নিউক্লিয় বল:- এটাকে দুর্বল বলা হয় কারণ তড়িৎচুম্বকীয় বল থেকে এটা প্রায় লক্ষকোটি গুণ দুর্বল, কিন্তু মহাকর্ষ বলের মতো এত দুর্বল না। মহাকর্ষ এবং তড়িৎচুম্বকীয় বল যে কোনও দূরত্ব থেকে কাজ করতে পারে, কিন্তু এই বলটি খুব অল্প দূরত্বে কাজ করে। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে বিটা ভাঙনের ফলে যে বিটা ইলেকট্রন বের হয় সেটার কারণ এই দুর্বল নিউক্লীয় বল। বোসন নামক কণার পারস্পরিক বিনিময়ের জন্য এই বল কার্যকর হয়।
বলের একীভূতকরণ বা একীভবন ক্ষেত্র তত্ত্ব (Unified field theory):-
চারটি মৌলিক বলকে একই তত্ত্বের মাধ্যমে প্রকাশ করাকে বলা হয় বলের একীভবন ক্ষেত্র তত্ত্ব। দুর্বল নিউক্লিয় বল এবং তড়িৎচুম্বকীয় বলের একীভবন থেকে উদ্ভূত বলকে বলা হয় তড়িৎ দুর্বল বল বা গ্লাসো-সালাম-ওয়াইনবার্গ বল।