আমরা সাধারণ মানুষেরা জানি যে, যে মানুষ ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ম্যাথামেটিকস বোঝেন ‐‐
যিনি বেসিক ইউনিটস, ডিরাইভড ইউনিটস, পদার্থ, তাপ, গতি, বল, শক্তি ,ভেক্টর, বোঝেন—যিনি প্রোটন নিউট্রন ইলেকট্রন, কোয়ার্কস , কোয়ান্টাম বিষয়গুলি বোঝেন–যিনি লগারিদম, ত্রিকোনোমিতি পারমুটেশন কম্বিনেশন ,মেট্রিকস, স্যাটিসটিকস, ক্যালকুলাস বা নিউমেরিকস বোঝেন–যিনি কমপিউটার ,সোপার কমপিউটার বোঝেন—যিনি প্রানী ও উদ্ভিদের স্ত্রী পুরুষ কোষ কলা জিন , প্রোটিন, হরমোন কি এবং কেন জানেন --- যিনি প্রাণী শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও তার কার্যকলাপ বিষয়ে অনেক কিছু বোঝেন ও তাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন ---যিনি মোটর ইঞ্জিন উড়োজাহাজ ডুবোজাহাজ রকেট তৈরী করতে জানেন ----যিনি স্পেস, ইউনিভার্স, এন্টি ইউনিভার্স , গ্রহ নক্ষত্র মহাবিশ্ব অভিকর্ষ মহাকর্ষ চেনেন বোঝেন— তাদের মধ্য কেউ কেউ কোনো বিদ্যালয়ে বা শিক্ষালয়ে বিজ্ঞানের উপরোক্ত বিষয়গুলির যে কোনো একটি বিষয়ে শিক্ষক হতে পারেন !
শিক্ষক নিজে কতটা শিক্ষিত বা শিক্ষিতা ? :--
অথচ আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য রকম আশ্চর্য জনক একটা বিষয় হলো এটা ----প্রাণীকূলের কাছে সর্বোচ্চ স্তরের সর্বকালের মহান শিক্ষক যিনি, অর্থাৎ সেই প্রকৃতি, তিনি এই বিষয়গুলোর কিছুই বোঝেন না, জানেন না ! তিনি নিজে কতটা শিক্ষিত বা শিক্ষিতা ?
অথচ সুক্ষবিচারে আমরা দেখি এক বিস্ময়কর শিশুর মতো তিনি শুধু জানেন কেবল তিনটি জিনিষ--,CTO মানে Creation, Transformation and Order! আর এই তিনটি জিনিসই তাঁর সৃষ্টিজগতের চলমান পদ্ধতিকে বজায় রাখতে অতিব আবশ্যিক বিষয়!
তাহলে প্রকৃতি লগারিদম জানলেন কেমন করে ? :---
বিজ্ঞানের নামে মানুষ প্রকৃতির রহস্যজনক ও বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির এক একটি বিষয় আবিস্কার করে আশ্চর্য হয়ে যায় আর তার সামনে খুলে যাওয়া আরও বৃহত্তর রহস্যের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে যায়, অজানাকে জানার নেশায় , বিজ্ঞানচর্চার নেশায় মশগুল হয়ে যায়!
এই রকমই দুজন মানুষ যাঁদের নাম মিস্টার ওয়েবার আর মিস্টার ফেকনার ! গবেষণা করতে করতে মানুষের স্নায়ুকোষের বা মগজের অনুভূতির ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই সেদিন ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে আবিষ্কার করলেন বিজ্ঞানের এক নতুন প্রশাখা Psychophysics বাংলাতে আমি বলতে পারি "মনোপদার্থবিদ্যা "! বিষয়টি অবশ্য ই-এন-টি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুদের জানার কথা ! ফেকনার সাহেব তাঁর গবেষনণাতে সুত্রাকারে লিখলেন :---
"Intensity of sensory response is proportional to the logarithm of the stimulus intensity !"
অর্থাৎ "মানুষের অনুভুতির তীব্রতা উত্তেজনা সৃষ্টিকারী শক্তির তীব্রতার সাধারণ লগের সমানুপাতী!"
এই সুত্রটি "ফেকনারস সাইকোফিজিক্যাল ল্" হিসাবে পরিচিত !
এটিকেই আর একভাবে ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় :--
--" মানুষের অনুভূতি তীব্রতা গনিতের ভাষাতে এরিথমেটিক্যাল প্রগ্রেশনে বাড়ে যখন উত্তেজনার তীব্রতা বাড়ে জিওমেট্রিক্যাল প্রোগ্রেশনে !"
অর্থাৎ প্রকৃতি জেনে শুনে বিচার করে আমাদের স্নায়ুকেন্দ্রে তীব্রতার অনুভূতিটা আনুপাতিক হারে কম করে রেখেছেন ! না হলে উত্তেজনার আসল তীব্রতা স্নায়ুকেন্দ্রে অনুভূত হলে সেটা নিশ্চয়ই আমাদের অনুভূতির জগতে যন্ত্রনাকর গোলমাল পাকাতো ! খুব কম তীব্রতা ও অতি উচ্চ তীব্রতার উত্তেজক ছাড়া আলো আর শ্রবন ক্ষমতার ক্ষেত্রে ফেকনারের এই সুত্রটি প্রমানিত সত্য !
ইনটেনসিটি ও ডেসিবেল :--
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে এই সেদিন মানে ১৬১৪ খৃষ্টাব্দে স্কটিশ গনিতবিদ জন নেপিয়ারের লগারিদম পদ্ধতির আবিষ্কারের আগেই প্রকৃতি লগারিদমকে কি নিখুঁত প্রয়োগ করে রেখেছেন আমাদের অনুভূতির জগতে !
উদাহরণ:---
আমরা সবাই জানি আমাদের শ্রবনেন্দ্রিয় একটি সাংঘাতিক সুক্ষ ও সংবেদনশীল অঙ্গ ! আমরা এও জানি আমাদের কানের পর্দা ১৬ হার্টজ থেকে ২০ কিলো হার্টজ পর্যন্ত সাউন্ড ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জে সংবেদনশীল ! তরঙ্গের মাধ্যমে শক্তি পরিবাহিত হয় ! তাই তার চাপ দেবার ক্ষমতা আছে ! আর আমাদের কানে ১বর্গ সেন্টিমিটার আকারের একটি পাতলা স্থিতিস্থাপক পর্দা অতি ক্ষীণতম শব্দ তরঙ্গের চাপে কম্পিত হতে জানে ! কত কম সেই চাপ?
উত্তর হলো 2×10^–5 Newton!(টেন টু দি পাওয়ার মাইনাস ফাইভ নিউটন ) যার অর্থ হলো ২ নিউটনের ১ লক্ষভাগের একভাগ চাপ বা ১ নিউটন চাপের ৫০০০০ ভাগের একভাগ চাপে সে কাঁপে আর মগজে উত্তেজনা পাঠায় শব্দ অনুভূতির ! সুতরাং বুঝতেই পারছেন বিশ পঁচিশ তলা লিফটে উঠলে বাইরের বায়ুচাপের যেটুকু পরিবর্তন হয় আমাদের কান সেটা সেন্স করতে সক্ষম আর তাই পর্দার দুদিকে এই তারতম্যের ফলে কানে চাপ বা তালা লাগে! অনেক সময় সর্দি কাশি ঠান্ডা লাগাতেও কানের ভিতর বাইরে চাপের সামান্য হেরফের আমরা কানের অনুভূতির ফারাকের মাধ্যমে টের পাই ! এই জন্যই ডাক্তারবাবুরা যখন তখন কাঠি দিয়ে কান খোঁচাতে বা রাস্তাঘাটে যাকে তাকে দিয়ে কান পরিস্কার করতে মানা করেন !
সমুদ্রতলের বায়ু চাপকে ১ কেজি প্রতি সেন্টিমিটার ধরলে সেটা ৯.৮ নিউটনের মতো বা সরল করে বললে ১০ নিউটনের মতো ! এবার ভাবুন কত সুক্ষ সংবেদনশীল আমাদের কানের পর্দা ও তার কর্মকুশলতা! তাইতো ডাক্তার বাবুরা অতি সাবধানে খুব আলতো করে স্যলিসাইলিক এসিডে ভেজানো তুলো একটা মেটালিক প্রোবে লাগিয়ে কানের পর্দা পরিস্কার করেন তখন বেশ যন্ত্রনার অনুভূতি হয় !
শব্দের তীব্রতার মাপ:--
কানের পর্দার মাধ্যমে মস্তিষ্কে অনুভূত শব্দের লাউডনেস মাত্রা মাপার একক হল বেল (bel) আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের নাম অনুসারে ! আমরা কানের মাধ্যমে অনুভূত লাউডনেস মাপি ১ বেল ২ বেল ৩ বেল এই এরিথমেটিক প্রগেশনে ! আর বাস্তবে এই ইনটেনসিটি বা তীব্রতা হল ১০ এর গুনিতকে ! অর্থাত ১ বেল বা (১০ ডেসিবেল) হল ১০ মাত্রার তীব্র --২ বেল মানে ১০০ মাত্রার তীব্র!
গাছের শুকনো পাতা মর্মর ধ্বনি ১বেলের মতো তীব্র ! জোরে কথা বলা ৬.৫ বেলের মতো ! তাহলে আমাদের কথার তীব্রতা ঐ ঝরা পাতার শব্দের তীব্রতার ১০^(৬.৫-১)
= ৩১৬০০গুন বেশী ! কিন্তু আমাদের অনুভূতি ঐ ৩১৬০০ সংখ্যাটির কমন লগারিদম (বেস ১০ ধরে ) দাঁড়ায় ৫.৫ !
সিংহের গর্জনের তীব্রতার মাপ ৮.৭ বেল (বা ৮০ ডেসিবেল) !
তাহলে ঐ এক হিসাবে সিংহের গর্জন ১০^(৮.৭-৬.৫)= ১০^২.২=১৫৮
অর্থাত আমাদের জোরে কথাবার্তার চেয়ে সিংহের গর্জন ১৫৮গুন তীব্র ! অথচ আমাদের মগজ সেটা ৮৭ ডেসিবেল বা ৮.৭ বেল হিসাবে অনুভব করে ! আবার আমাদের কানদুটির অবস্থান মাথার বীপরীত দিকে এবং তার বাইরের গঠনটা এমন কায়দাতে ভাঁজ খাঁজ করে করা যাতে শব্দের প্রতিফলনের সাহায্য নিয়ে আমরা শব্দের সঠিক উৎস ঠিকঠাক বুঝতে পারি আর শব্দের শক্তিও যেন কানের বাইরের দেওয়ালে শোষিত হয়ে খানিকটা প্রশমিত হয়ে যায় পর্দাতে পৌঁছানোর আগে ! সেটা আর একটা বিষয় !
বায়ুচাপের সাথে dB রিলেশন:--
I(dB)= 10log(I measurable/ I (reference)
= 10 Log(Pmeas/pref)^2
= 20Log(p /p (ref)
সুতরাং শব্দ কর্তৃক সৃষ্ট বায়ু চাপের দ্বিগুন হলে অর্থাৎ আমাদের শ্রবন ক্ষমতার মিনিমাম ভ্যালু বা Threshold of hearing or Reference level of hearing এর দ্বিগুন হলে তখন সুত্র অনুযায়ী dB ভ্যালু হবে 20×(.30)= 6
আমাদের কানের শ্রবন ক্ষমতার রেফারেন্স লেভেল "0"-dB ! 10 dB কে 1 ধরা হয় , 20 dB কে 2 ধরা হয় ! ইত্যাদি !
" ডিজের তালে মগজ দোলে":--
শব্দ এক ধরনের শক্তি আর সেই শক্তি শব্দ তরঙ্গের এমপ্লিচুড ও কম্পাঙ্কের বর্গের সাথে সমানুপাতি ! তাই শব্দের কম্পাঙ্ক বা এমপ্লিচুড বাড়লে আমাদের কানে পৌঁছানো অতিরিক্ত শব্দশক্তি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে ও মগজে অস্বাভাবিক ও ক্ষতিকর অনুভূতির সৃষ্টি করে ! যার জন্য পাবলিক প্লেসে জোরে লাউডস্পীকার বাজানো পৃথিবীর বহু সভ্য দেশে ব্যান্ড করা হয়েছে ! অথচ আমাদের দেশে বিশেষ করে এই পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব সহ কথায় কথায় নানা উৎসবে অনুষ্ঠানে অতি উচ্চ নাদে লাউডস্পীকারের অপব্যবহার করেন ! সাধারণ মানুষের কষ্ট অস্বস্তিকর অবস্থার কথা মোটেই ভাবেন না ! বারণ বা প্রতিবাদ করলে কপালে জোটে তিরস্কার!
পরিশেষ:--
সুতরাং ভাবলে সত্যিই মনে হয় প্রকৃতির মতো কখনো সাদাসিদে বিনয়ী কখনও বা জটিল চরিত্রের আপাত দৃষ্টিতে "অশিক্ষিত " অথচ এত মহান প্রযুক্তিবিদ, গনিতবিদ ও বিজ্ঞানী আর কে আছেন ??
--সমীর ব্যানার্জী
(চিত্র সংগৃহীত)