নুপূর
মানুষটাকে কখনো বলা হয়নি আমি তাকে অনেক ভালোবাসি।সবাই বলে, ভালোবাসতে নাকি সাহস লাগে কিন্তু আমি বলি ভালোবাসতে সাহস লাগে না,সাহস লাগে ভালোবাসা প্রকাশ করতে,প্রচুর সাহস লাগে।
মানুষটার নাম নিহন। সে আমার বান্ধবীর বড় ভাই।গত বছর একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করেছে, আপাতত একজন শিক্ষিত বেকার।যদিও সে তার বেকারত্ব বেশ উপভোগ করে এবং সর্বোচ্চ যতদিন সম্ভব বেকার থাকা যায় ততদিন পর্যন্ত বেকার থাকার ইচ্ছে তার।
সে মেয়ে মানুষ হলে এতদিনে বুঝে যেতো আমি তাকে ভালোবাসি।
ছেলেদের অনুভুতি শক্তি ভোঁতা হয়।এরা চোখের ইশারা তো বহুদূর মুখের ভাষাও সব সময় বুঝতে পারে না। এক ধরনের ছেলেদের যদি শান্ত গলায় বলা হয়, "ভবিষ্যতে আমি আপনার বাচ্চাদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী",এরা স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিবে,আরে না, তোমার প্রয়োজন হবে না,আমার বাচ্চাদের দায়িত্ব তাদের মা-ই নিতে পারবে।
আমি অবশ্য আমার ভালোবাসা বোঝানোর চেষ্টাও করি নি কখনো ,করি না।
নিহন খুব সহজ-সরল একজন মানুষ আর আমি অতি চঞ্চল মেয়ে মানুষ।আমি সেচ্চাচারী আর একগুঁয়ে।আমার মিথ্যা বলতে ভালো লাগে।মিথ্যাকে সত্যের মত বলতে পারা একটা গুণ আর আমি সে গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। আমার বলা মিথ্যে ধরার জন্যও অনেকদিন লেগে যায় মানুষের।আমি আমাকে ছাড়া আর কিছুই বুঝি না।আত্নকেন্দ্রীক যাকে বলে আরকি।আমার বন্ধু খুবই কম। আমার সাথে কেউই ভালো থাকবে না তাই শুধু শুধু নিহন জড়িয়ে কষ্ট দিতে চাই না কিংবা সে যদি জানার পর আমাকে উপেক্ষা করে সেটাও আত্মসম্মানে লাগবে বলেই হয়তো দূরে থাকি আমি।
ভালোবাসা ক্ষণস্থায়ী,আজ আছে তো কালকে আজকের চেয়ে কম থাকবে আর পরশু হয়তো থাকবেই না।
ভালবাসা হচ্ছে হাউয়াই মিঠাই এর মতো,কাঁচের বাক্স থেকে বের করলেই যেমন তা আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে যায় তেমনি ভালোবাসা পাওয়ার পর এমন করেই মিলিয়ে যেতে থাকে।তাই আমার ভালোবাসা কাঁচের বাক্সে বন্দী করেই রেখে দিয়েছি।
আমি মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি একটা শান-বাঁধানো পুকুর পাড়ে ভরা জোৎস্না রাতে নিহনের হাত ধরে বসে আছি। স্বপ্নকে প্রশ্রয় দিতে নেই।প্রশ্রয় পেলে স্বপ্নেরা আকাশ ছুঁতে চায়।তাই স্বপ্নগুলোকেও কাঁচের বাক্সে বন্দি করে রাখতে হয়।
নিহনের হাসি সুন্দর।শুধু সুন্দর না, অসম্ভব সুন্দর। সে বাচ্চাদের মতো শব্দ করে হাসে।অনেক দিন নিহনের হাসির শব্দ শোনা হয় না তবুও সে শব্দ এখনো কানে বাজে।
আজ নিহনের বোন মানে আমার বান্ধবীর বিয়ে,বাড়ির চারপাশে ঝলমলে আলো আর বাড়ি ভর্তি অতিথি,তাদের মধ্যে আমিও একজন অতিথি।এতো মানুষের মধ্যে একজন খুবই ব্যস্ত।ছোট বোনের বিয়েতে একমাত্র ভাই ব্যস্ত থাকবেই।
রাতে আমি বাড়ির দক্ষিন দিকের শানে-বাঁধানো পুকুর পাড়ে একা বসে আছি।পুকুরের পানিতে চাঁদ ছলছল করছে।প্রকৃতির সৌন্দর্য সবাইকে ছুঁয়ে যায়।আমাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন এসে আমার পাশে বসলো। আমি জানি সে নিহন। আমি পিছনে না তাকিয়েই দেখতে পাচ্ছি চাঁদের আলোয় পুকুরের শান্ত পানিতে চকচক করছে তার মুখ কিন্তু মুখে কোন কথা নেই।
নিহন কেনো আমার পাশে এসে বসেছে সেটা জানতে চাই নি।ভালোই তো লাগছে সে পাশে বসে আছে,থাকুক। আর
আমার পাশে বসা তো আর দন্ডনীয় অপরাধ না, যে কেউ বসতে পারবে না।কেউ আমার পাশে বসলে আমি সাপ বা ব্যাঙ এ পরিণত হবো এমন কিছুও না বরং আমার ভালোই লাগছে এখন।
বেশ কিচ্ছুক্ষণ পর নিহন পকেট থেকে কিছু একটা বের করলো আর সেটার শব্দে বুঝলাম সেটা নুপূর। নিহন নীরবতা ভেঙ্গে বললো,"পিয়া,আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখি এই পুকুর পাড়ে তোমার হাত ধরে বসে আছি আর তোমার নুপুরের আওয়াজ চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে।এতোদিন বলি নি কিন্তু আজ না বললে হয়তো অনেক দেরী হয়ে যাবে। তুমি কি এই নুপুর পড়তে আগ্রহী?"
আমার খুব খুশি হওয়া উচিত কথাগুলো শুনে কিন্তু আমার চোখে পানি চলে এসেছে।এখন আমার উচিত নিহনের হাত ধরে তাকে ভালোবাসি বলা কিন্তু আমার হাত মনে হচ্ছে জমে গেছে,নড়াতে পারছি না।আমি তাকে ভালোবাসি এটা হয়তো আর কোনদিন না প্রকাশ করলেও চলবে,একজন ভালোবাসলেই হয়।ভালোবাসি ঘটা করে বলার দায়িত্বটা না হয় ওর কাঁধেই থাকলো সারাজীবন।
আমি বললাম,নুপুর পরলে আমার নিজেকে শেকলে আবদ্ধ মনে হয় আর পা ভারী লাগে।হাঁটতে অসুবিধা হয়। আমি স্বাধীনচেতা মানুষ এসব শেকলে আবদ্ধ হতে চাই না আমি।আপনার নুপূর আমি পরতে পারবো না। তবে নুপুরগুলো রেখে দিতে পারি আমাদের মেয়ের জন্য।
নিহন হাসলো,বাচ্চাদের মতো শব্দ করে হাসলো আর বললো, "ভালোবাসি"।