#The_Toxic_Lady
কখনো এমন সব ঘটনা ঘটে যা চিকিৎসা বিজ্ঞানকেও বিভ্রান্ত করে দেয়। তেমনই এক ঘটনা ঘটেছিল দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড জেনারেল হাসপাতালে। ১৯৯৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় হাসপাতালে উপস্থিত হন এক নারী। অবস্থা তার খুবই খারাপের দিকে।
ক্যান্সারের একদম অ্যাডভান্স স্টেজে আছেন তিনি। এছাড়াও মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তার। রোগীর প্রবল কষ্ট হচ্ছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তড়িঘড়ি করে ইমার্জেন্সি রুমে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ওষুধ দেয়ার পর রক্ত সংগ্রহ করতে গেলেন নার্সরা। তখনই ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা।
রক্ত নেয়ার সময় হঠাৎই অসুস্থ বোধ করেন মেডিকেল স্টাফরা। ধীরে ধীরে আরো অনেকে অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। একজন রোগীকে দেখতে গিয়ে এরকম অবস্থা? অথচ তারা তো সুস্থই ছিলেন! নব্বইয়ের দশকে আমেরিকায় এমনই একটি ঘটনা সবার নজর কেড়েছিল। রাতারাতি খবরের কাগজের শিরোনামে জায়গা করে নেয় এটি। এই নারীকে ‘দ্য টক্সিক লেডি’আখ্যা দেয় পত্রিকার সম্পাদকেরা।
এই নারীর আসল নাম গ্লোরিয়া রামিরেজ। ১১ জানুয়ারি ১৯৬৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৩১ বছর বয়সী গ্লোরিয়া রামিরেজ স্বামীর সঙ্গে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইডে বসবাস করতেন। অন্য দশ জনের মতো সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন তিনি। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। একসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন গ্লোরিয়া। পরীক্ষায় ধরা পড়ল সারভাইকাল ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে গ্লোরিয়ার শরীরে। তারপর কেমোথেরাপি এবং নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে দিয়েই চলছিল তার দিন।
❇️ ঘটনার দিন হঠাৎ করেই সন্ধ্যা থেকে গ্লোরিয়া অসুস্থবোধ করতে থাকেন। সময় বাড়ার সঙ্গে তার অবস্থারও অবনতি ঘটতে থাকে। পরিবারের লোকজন দেরি না করে তাকে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এলেন। গ্লোরিয়া ক্যান্সারের পাশাপশি শারীরিক অন্যান্য রোগেও ভুগছিলেন। তার পালস রেট একেবারেই কমে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে শ্বাস নিতেও সমস্যা হচ্ছিল তার।
❇️ রহস্যের সূত্রপাত ঘটে ইমার্জেন্সি রুমে!
প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দেয়ার পর ডাক্তাররা লক্ষ্য করেন, গ্লোরিয়ার নিঃশ্বাসের সঙ্গে অদ্ভুত একটি ঝাঁঝালো গন্ধ বেরিয়ে আসছে। বুকের চামড়াও কেমন যেন হয়ে গেছে। দেরি না করে রক্ত নেয়া শুরু করলেন ডাক্তাররা। সেখানেও দেখলেন সমস্যা। টিউব থেকে অ্যামোনিয়ার মতো গন্ধ বেরিয়ে আসছে। আবার রক্তে কী যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। সাদা স্ফটিক এর মতো ভাসমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা। বাকিটা পরীক্ষা করতে যাবেন, হঠাৎই ইমার্জেন্সি ঘরে থাকা তিনজন অসুস্থ হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হারান। সঙ্গে সঙ্গে তাদের বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন শ্বাসযন্ত্রের বিশেষজ্ঞ মরিয়েন ওয়েলচ।
এখানেই শেষ না। বলতে গেলে বিপদ শুরু এখানেই। যারাই গ্লোরিয়ার কাছে আসছেন, তারাই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন! এক দুই করে ২৩ জন এভাবে অজ্ঞান হয়ে যান। পাঁচজনের অবস্থা এতই খারাপ হয়ে পড়ল যে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুরো হাসপাতাল জুড়েই তখন বিশৃঙ্খল অবস্থা। এদিকে গ্লোরিয়ার অবস্থাও খারাপ হচ্ছে ক্রমশ। অন্যদিকে তার কাছে যেই যাচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারদের কিছুই করার ছিল না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪৫ মিনিটের মধ্যেই মারা গেলেন গ্লোরিয়া রামিরেজ।
এরপর শুরু হয় তদন্ত। খবরের কাগজগুলো গ্লোরিয়ার নাম দেয় ‘টক্সিক লেডি’। কয়েকদিন ধরে চলল অটোপ্সি। সব নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষায় বসলেন বিশেষজ্ঞরা। তদন্তে ছিলেন দুই বিজ্ঞানী। একজন ড. আনা মারিয়া ওসোরিও এবং অন্যজন কার্স্টেন ওয়ালার। তারা ১৯ ফেব্রুয়ারি জরুরি বিভাগে কর্মরত ৩৪ জন হাসপাতালের কর্মচারীর সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন। যেসব স্বাস্থ্যকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাদের থেকেও বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেন। মরিয়েন ওয়েলচ বলেছিলেন, ঝাঁঝালো এক ধরনের গন্ধ পেয়েছিলেন তারা। এরপর তাদের মাথা ব্যথা করতে থাকে এবং জ্ঞান হারান।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি ছিল। বিশেষজ্ঞরা তত্ত্ব দেন, হাসপাতালের কর্মীরা হিস্টিরিয়ায় ভুগছিলেন। গ্লোরিয়ার দেহটি হাসপাতাল থেকে অপসারণ করতে কর্মীরা হ্যাজমাট বায়ো কন্টেইনমেন্ট স্যুট পড়ে নিয়েছিল। ময়নাতদন্তে গ্লোরিয়ার শরীরে কোনো বিষের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে পরীক্ষার শেষে উঠে আসে বেশ কিছু তত্ত্ব। তার মধ্যে একটি তত্ত্বকেই এখনো পর্যন্ত প্রামাণ্য হিসেবে মনে করা হয়। যদিও সেটাও কিছুটা অনুমানের ভিত্তিতেই বলা হয়েছিল।
লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির তদন্তে বলা হয়, বাড়িতে অসুস্থ হওয়ার সময় হয়ত গ্লোরিয়া রামিরেজ এমন কোনো ওষুধ খেয়েছিলেন যার মধ্যে ডাইমিথাইল সালফক্সাইড যৌগটি ছিল। কারণ শরীরে যে পরিমাণ ডাইমিথাইল সালফক্সাইড থাকার কথা। তার থেকে তিনগুণ বেশি ছিল গ্লোরিয়ার শরীরে। এটি অনেক সময় ব্যথা কমাতেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে গ্লোরিয়ার যেহেতু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তাই হয়ত এ ধরনের কোনো ওষুধ তিনি খেয়েছিলেন। সেটাই তার শরীরের ভেতরে বিষক্রিয়া ঘটায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেটা আরো বেড়ে যায়।
অন্যান্য ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে বিষক্রিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। আর তারই ফলেই তার মৃত্যু হয় পাশাপাশি অন্যরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এছাড়াও গ্লোরিয়ার রক্তে পাওয়া যায় টাইগল নামক টেলিনল, লিডোকেন, কোডিন এবং বমিরোধক ওষুধ। যা শরীরের মধ্যে অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা। এভাবেই তার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
তবে ফরেনসিক সায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, এটি বৈজ্ঞানিক মহলে এখনো বিতর্কের বিষয়। এরকম বিয়োগান্তক মুহূর্তই বোধ হয় অপেক্ষা করে ছিল গ্লোরিয়ার জন্য। মারা যাওয়ার দুইমাস পরে ২০ এপ্রিল রিভারসাইডের অলিভউড মেমোরিয়াল পার্কে তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুর প্রায় ১০ সপ্তাহ পর গ্লোরিয়ের শরীর তখন প্রায় পচে গিয়েছিল। কমিকসের পাতা থেকে যেন বাস্তবে উঠে এসেছিল ‘টক্সিক লেডি’।
সূত্র: মিস্টিরিয়াসইউনিভার্স / ডেইলি বাংলাদেশ