বিজ্ঞান বুঝবে এবং আত্মস্থ করবে শুধু মেধাবীরাই, তা হয়না। বিজ্ঞানকে এলিট না ভেবে একটু মিডলক্লাসের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়ালেই সুবিধা হয় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের।আবার মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করা যাবেনা..তাও হয়না!
"যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয় না, তারা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না।"
আসলে বিজ্ঞান মাতৃভাষায় খুব সহজভাবেই বোঝানো যায়, তার জন্য নিজেকে আগে বুঝতে হয়, আত্মস্থ করতে হয়। উদাহরণগুলো খুঁজে নিতে হয় আমাদের চারপাশ থেকেই। থিওরিকে বিজ্ঞানের ভাষায় যত ভালোভাবেই বোঝান না কেন সেই ভাষাটা অনেকের কাছেই বিরক্তির উদ্রেক ঘটাতে পারে,অনেকে ইন্টারেস্ট না পেয়ে খেই হারিয়েও ফেলে। তাই কিছু বাস্তব উদাহরণের সাহায্যে বোঝালে তা যেমন স্টুডেন্টদের কাছে বোঝার সুবিধে হয় ঠিক তেমনি শিখনটা হয় joyful learning.
উচ্চমাধ্যমিকের রসায়নে এরকমই কিছু উদাহরণ....
১. স্থিরানুপাত সূত্র:
ওই যে অবাক জলপান..ডাবের জল, চোখের জল, নাকের জল..আমাদের পান করা টিউবওয়েলের জল, অ্যাকোয়াগার্ডের জল, কেনা জল বা বিরাট কোহলির ৩ হাজার টাকা দামের জল। ঝরনার জল,নদীর জল হোক বা ল্যাবরেটরিতে বানানো জল...সবারই সংকেত কী?
২. তুল্যাংকভার:
পরমাণুর ক্ষেত্রে সংজ্ঞা বা পারমাণবিক ওজন÷যোজ্যতা তো হ'ল কিন্তু যৌগের ক্ষেত্রে?
ভালো ফুটবলার কাকে বলবো? এককথায় তা বলা যায়না। ভালো গোলকিপার যে গোল সেভ করবে, ভালো ডিফেন্ডার যে বিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করবে,ভালো মিডফিল্ডার যে খেলা তৈরি করবে এবং পাস বাড়াবে,ভালো স্ট্রাইকার যে গোল করবে! একইভাবে অম্ল যতগুলো H+ দেবে,ক্ষার যতগুলো OH- দেবে, জারক-বিজারক যতগুলো ইলেকট্রন নেবে বা দেবে তা দিয়ে ভাগ করতে হবে আণবিক ওজনকে!
৩. কৌণিক ভরবেগ:
শুধু ভরবেগ নয় কেন? বাড়ি দরজাকে হাতলে ধরে টানলে বা ঠেললে যত সহজে তা করা যায় কব্জার কাছাকাছি গিয়ে করলে তা অনেক কষ্টকর। দরজার গতিপথ বৃত্তীয়। তাই বৃত্তীয় গতিপথে ভরবেগ শুধু না নির্ভর করে ব্যাসার্ধের উপরেও তাই কৌণিক ভরবেগ -mvr.
৪. অপকেন্দ্র বল:
গাড়িতে বসে থাকলে কোন বাঁক ঘোরার সময় আমরা বাঁকের বাইরের দিকে হেলে যাই। কেউ কারুর গায়েও পড়ে যাই! এটাই অপকেন্দ্র বল!
৫. ডি ব্রগলি:
ইলেক্ট্রনের ঘূর্ণন পথ পুরো সেটিংস-এর আইকন!
৬. আউফবাউ নীতি:
বিল্ডিং বানানোর সময় ছাদঢালাই 1st floor থেকে শুরু হয় তারপর তার উপর, তার উপর..!
৭. হুন্ডের সূত্র:
বাসে উঠে সবাই জানলার ধারের সিটে গেল, কেউ আগেভাগে একজনকে দেখে সেখানে গিয়ে বসতে চায়না জানলার ধারের সিট ফাঁকা থাকলে!
আবার ট্রেনে দু'ধারের ৬টা সিটে নিজের ফ্যামিলির দ্বারা ভর্তি করে দিলে স্বস্তি পায় সবাই!
৮. পাউলির অপবর্জন নীতি:
দুই বন্ধুর একই স্কুল, একই ক্লাস, একজায়গাতেই বাড়ি...কিন্তু বাড়িটা, বাবামা আলাদা!
আবার দুই যমজ ভাই একই বাড়ি,একই মা-বাবা,স্কুল, ক্লাসও একই..কিন্তু নাম আলাদা!
৯. তড়িৎ ঋণাত্মকতা ও ইলেকট্রন আসক্তি:
২ জনের সিটে একজন নিজের সিট ছাড়াও অন্যের সিটে অনেকটা দখল করে নিল--তড়িৎ ঋণাত্মকতা।
আর অন্যের সিটটাও নিয়ে নিলে সেটা ইলেকট্রন আসক্তি!
১০. ওভারল্যাপিং,বন্ডিং,অ্যান্টি বন্ডিং:
হ্যান্ডশেক তালু -তালুতে হয়। মানে একই ফেজ আর হ্যান্ডশেক করলেই সেখানটা মোটা লাগে। এটা বন্ডিং!
আর তীব্র অনিচ্ছায় একজন হাত বাড়ালে তালুতে তালু না দিয়ে অন্যদিকটা ছুঁয়ে দিলে সেটাতে হ্যান্ডশেক হয়না! অ্যান্টি বন্ডিং!
এক্ষেত্রে constructive & destructive interference বোঝাতেই হবে।
স্কুলে সবাই আস্তে আস্তে কথা বললে বা রুমে ২-৩ জন বন্ধু আস্তে আস্তে কথা বললেও বাইরে জোরে শব্দ শোনা যায়! শব্দ একটি তরঙ্গ। আর সবার ফেজ একই(মানুষ)!
রুমে ফোনে কথা বলার সময় বাইরে যাতে আওয়াজ না যায় সেজন্য আমরা ফ্যান চালাই!
১১. হাইব্রিডাইজেশন নির্ণয়ে π বন্ধন কাউন্ট হয়না:
একতলা বাড়ি করতে যদি ২ কাঠা জায়গা লাগে, ২ তলা বাড়ি করতে কত কাঠা জায়গা লাগবে?
১২. বন্ধন দৈর্ঘ্য --এক বন্ধন > দ্বিবন্ধন > ত্রিবন্ধন:
একটা লেপ বা কম্বলকে একটা দড়ি দিয়ে বাঁধলে যা বেড় হয় ২ বা ৩ বার প্যাঁচালে তার চেয়ে কম হয়!
১৩. বর্ণালী :
কেন নির্দিষ্ট সিরিজের n1 নির্দিষ্ট?
উগান্ডা,টোগো,বেলাইজ,চীন,জাপান,আমেরিকা, ইংল্যান্ড,ফ্রান্স,অস্ট্রেলিয়া যেখানেই ভারতীয় নাগরিকরা থাকুক না কেন আর কলার তুলে যতই বলুক না কেন যে "আমরা abroad এ থাকি!"-এই মহামারীতে তারা সবাই ভারতেই আসতে চেয়েছে!
১৪. HOMO & LUMO:
ছাদ ঢালাই নীচ তলা থেকে শুরু হয় আর ঘর ভাঙলে উপর তলা থেকে ভাঙা হয়।
তাই ইলেকট্রন সবার উপরের (highest) ভরা(occupied) MO থেকে যাবে, আর ইলেকট্রন পূরণ হওয়ার সময় সবার নীচেকার (lowest) খালি(unoccupied) MO তে পূরণ হবে!
১৫. বন্ধনক্রম ও স্থায়িত্ব:
দুটো species এর বন্ধনক্রম এক হলে যার antibonding ইলেকট্রন সংখ্যা কম তার স্থায়িত্ব বেশি!
২ জনের বাবারই ৫০ লাখ টাকা জমা আছে। প্রথম জনের বাবার ব্যাঙ্কে ২০ লাখ আর চিটফান্ডে ৩০ লাখ,দ্বিতীয় জনের ব্যাঙ্কে ৪০ লাখ আর চিট ফান্ডে ১০ লাখ! কার টেনশন বেশি আর কার কম?
১৬. বন্ডিং, অ্যান্টি বন্ডিং শক্তি:
ধোনী ও বিরাটের মধ্যে কে ভালো ক্যাপ্টেন? ধোনী! কেন? মাথা ঠান্ডা! তাহলে যার মাথা যত ঠান্ডা তার স্থায়িত্ব তত বেশি! মানে বন্ডিং MO -এর শক্তি কম আর অ্যান্টিবন্ডিং MO-এর শক্তি বেশি।
বন্ডিং মানে কাজ হয়ে গেল কিন্তু অ্যান্টিবন্ডিং মানে চেষ্টা করেও আলাদা ফেজের জন্য কাজটা হচ্ছেনা ফলে মাথা গরম হবেই!
১৭. কোলরাশ সূত্র:
যাদের আয় খুব কম তাদের সংসার চালাতে নাভিশ্বাস। দু'জনকেই আয় করতে হয়। স্বামী রিক্সা চালায় আর স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু যাদের আয় বেশি তাদের আবার সংসার চালাতে ২জনকেই আয় করতে হয়না!
১৮. L.P.-L.P.>B.P.-B.P. :
প্রত্যেকটাতেই ২টো করে ইলেকট্রন আছে তাও এরকম কেন?
কারুর কাছে ১০ টাকা নগদ আর ১০ টাকার চকোলেট আছে! দোকানদারের কাছে কোনটা বেশি দামী?
১৯. সবচেয়ে বেশি শক্ত সমযোজী যৌগ:
সাধারণভাবে আয়নীয় যৌগগুলি বেশি শক্তপোক্ত হয় কিন্তু সবচেয়ে বেশি শক্ত সমযোজী যৌগ(হীরক,বোরন কার্বাইড, টাংস্টেন কার্বাইড ইত্যাদি)।
ভারত, চীন বা আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের চেয়ে গরীব কিন্তু ভারতের মুকেশ আম্বানি বিশ্বের ধনীদের অন্যতম!
২০. Polarising power:
সমান ওজনের লোহা নিয়ে একটা নিরেট আর একটা পাতলা টিনের ফাঁপা বল ছুঁড়ে মারা হ'ল,কোনটা বেশি ড্যামেজ করবে?
বিয়ে বাড়িতে একজন সব ধরণের মেনু নিয়ে সব খেলো আর একজনকে স্টার্টারে স্যালাড,পকোড়া,তোপসে ফ্রাই যা দেওয়া হ'ল সব খেয়ে নিল? এরপরও কে খেতে পারবে? অবশ্যই দ্বিতীয় জন! তাই, innert গ্যাস কনফিগারেশনের চেয়ে pseudo innert গ্যাস কনফিগারেশনের পোলারাইজিং পাওয়ার বেশি।
২১.Colligative property:
এন্ট্রপি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় সহজে। প্রত্যেকেই চায় এন্ট্রপি বাড়াতে। মানুষ যত ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চাননা কেন কোথাও গন্ডগোল হলে কেউ দাঁড়ায় আবার কেউ না দাঁড়িয়েও ভাবে কী হ'ল ওখানে! মানে মানসিক অস্থিরতা চলতেই থাকে।
সেইভাবে একজন বিকেলে মাঠে খেলতে যেত বা আড্ডা মারতে যেত! মানে ওখানে এন্ট্রপি বাড়তো। আবার বাড়িতে প্রিয় বন্ধুরা আসার জন্য সে খেলতে যেতে চাইছে সেদিন! ঘরেই আড্ডা মেরে এন্ট্রপি বাড়াচ্ছে। তাই vapour pressure কমছে!
আবার তাদের মাঠে পাঠাতে গেলে জোর করে পাঠাতে হবে ঘরের আড্ডা থেকে উঠিয়ে! তাই elevation of boiling point.
- Nucleophilic Substitution Reaction:
২ জন একসাথে ছিল, কিছুদিন পর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল! তখন তৃতীয় জন এসে নির্ভয়ে একজনের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে সামনে এসে (racemisation) প্রস্তাব দিল! ০+০=২ হয়ে গেল! এই ছাড়াছাড়ির পর যে খুব স্বস্তিতে থাকবে,যার মধ্যে আগের সম্পর্ক নিয়ে তেমন আবেগ থাকবেনা মানে একাই ভালো থাকবে তাকেই অ্যাপ্রোচ করা তৃতীয় জনের পক্ষে মঙ্গল!
আবার একজন কারুর সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন তৃতীয় জন এল আর পুরোনো সম্পর্ক ফিকে হতে লাগলো এবং নতুন সম্পর্ক দানা বাঁধছে! একসময় ২জনকে নিয়ে নাজেহাল! মাথা কাজ করছে না(transition state)! অবশেষে "স্যরি রে" বলে কাটিয়ে দিল একজনকে! এক্ষেত্রে প্রথমজন জাঁদরেল হলে সেখানে তাকে অ্যাপ্রোচ করা সহজ নয়! তাই ১ ডিগ্রীর মতো কম মানসিক স্থিরতা যুক্তদেরই অ্যাপ্রোচ করা সহজ হয়!আবার একজন সম্পর্কে থাকাকালীন তাকে সরাসরি প্রস্তাব দেওয়া যায়না তাই পেছন থেকে অন্যভাবে! ফলে inversion of configuration.
২৩. আয়নীয় বন্ধন:
শক্তিশালী বন্ধন কিন্তু directionless. নিয়ম মেনে,আচার মেনে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হলেই সব বিবাহবন্ধন শক্তিশালী হয়না। অনেকে আবার বিয়ে না করেও একসাথে থাকেন। তাদের টানও মারাত্মক শক্তিশালী। আর বিয়ে হয়নি বলে কোন ডকুমেন্টেশান-এর প্রয়োজন বা প্রমাণ নেই!
২৪. তাপীয় স্থায়িত্বের ক্রম- PH4F
২ জন পার্টনার মিলে ব্যবসা শুরু করলো কিছুদিন পর একজন প্রচুর টাকা করে ফেললো যেকোন সোর্স থেকেই হোক! এবার সে এই ব্যবসা থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে চাইবেই! ফলে পার্টনারশিপ ভেঙে যাবেই।।যত বেশি স্বনির্ভর হবে তত বেশি অস্থায়ী হবে পার্টনারশিপ।
স্থায়িত্বের ক্রম-- HF>HCl>HBr>HI,তাই তাপীয় স্থায়িত্বের ক্রম উল্টো হবে।
২৫. তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রের ত্রুটি:
মুকেশ আম্বানি ও আমি --কে কাকে টাকা দেবে?
আম্বানির এত টাকা তাও বলা সম্ভব নয়! আমিও দিতে পারি প্রোডাক্ট কিনে। নাও দিতে পারি। যদি দেওয়ানেওয়া হয় তাহলে কত কে দেবে কেউ জানেনা!
তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রও তেমনি! শক্তির রূপান্তর হবে কিনা জানা যায়না,হলে কোন অভিমুখে হবে বা কতটা হবে তা জানা যায়না!
২৬. দ্রাব্যতা :
ভজা আর টেঁপি প্রেম করছে। তাদের আবার নিয়মিত দেখা না করলে ঠিক জমেনা! এই তো সেদিন ওই পাড়ার মোড়ে ন্যাড়া বটতলায় বসে গল্প করছে হঠৎ সেই ভরদুপুরে এক দাদু হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। দেখলো অপরিচিত, তারা হাত না ছাড়িয়েই হেলদোলহীন হয়েই গল্প করতে লাগলো।
আর একদিন পাড়ার পরিচিত হারাধন দাদুকে দেখলো,জানে দাদু এসব সাতেপাঁচে থাকেনা, তাও তারা সতর্ক হয়ে গেল। আর সেদিন তো পুরো কেলো, টেঁপির মেজদা আসছে দেখতে পেয়েই বটগাছের ওপাশে লুকিয়ে গেল!
ধুর ধুর,পাড়ার মোড়ে দেখা করা খুব চাপের। চলো যাই ভিক্টোরিয়া /মঙ্গল পান্ডে বা গোপগড়! ওখানে সবাই অপরিচিত হলে কী হবে, "আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মোর চোখ হাসে মোর মুখ হাসে!"
তার মানে সাধারণ আয়ন নেই অথচ তড়িৎ অবিশ্লেষ্য, কোন প্রভাব নেই দ্রাব্যতায়।
সাধারণ আয়ন থাকলেই দ্রাব্যতা কমবে।
আবার সাধারণ আয়ন নেই অথচ তড়িৎ বিশ্লেষ্য,দ্রাব্যতা বাড়বে!
চেষ্টা করলাম কিছু উদাহরণ দিতে। এরকম হাজারো উদাহরণ বিভিন্ন টপিকে দেওয়াব যায়। এভাবেই একটু চেষ্টা করলেই সাধারণ মেধার ছাত্রছাত্রীদেরও বিজ্ঞান বোঝানো যায়। সবার কাছে অনুরোধ যে সিলেবাস শেষ বা পড়ানো নয়,শেখান আনন্দ দিয়ে.. সহজভাবে। প্রত্যেকের নিজস্ব ভান্ডারের কিছু নমুনা দেখানোর অনুরোধ রইলো।
©প্রদীপ শাসমল