আমার বন্ধু নিফানের মনে ভারি দুঃখ। কারণ ওদের স্কুলে প্রতিবার অরণ্য সপ্তাহে সবাইকে ২ টি করে গাছ দেয় লাগানোর জন্য। ওদের যে গাছ লাগানোর কোথাও জায়গা নেই। নিফান তো ফ্ল্যাটে থাকে, ৩টা বড় টাওয়ার নিয়ে ওদের ক্যাম্পাস। ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটা সুইমিং পুল। তার পাশে কয়েকটা পাম-ট্রি রয়েছে। কংক্রিটের ফাঁকে চৌকা খোপে মাটির মধ্যে কয়েকটা ফুলের গাছ থাকলেও বড় গাছ নেই। মাটিও নেই যে ওরা কিছু গাছ লাগাবে।নিফানের গত ২বছরের স্কুল থেকে পাওয়া গাছ ব্যালকনিতে থেকেই মরে গিয়েছিল। গতবার তার বাবা ক্যাম্পাসের সেক্রেটারি শফিক কাকা কে বলেছিল যে গেটের ধারে টাইলস তুলে মাটি বার করে যদি গাছ লাগানোর একটু ব্যাবস্থা করা হত তাহলে সব বাচ্চারাই কিছু গাছ লাগাতে পারত।
কিন্তু শফিক কাকা শুনেই আঁতকে উঠেছিলেন। বলেছিল যে বড় গাছ লাগালে তার শিকড় চলে যায় আনেক গভীরে। আর বড় বড় বিল্ডিংয়ের ভিত নাড়িয়ে দেয় ঐ শিকড়। চারপাশে সব বহুতল বিল্ডিং। যদি ফাটল ধরে বাড়িগুলোয়। তাই বড় গাছ লাগানো হয় না ওখানে। অরণ্য সপ্তাহে কয়েকটা ছোট ফুলের গাছ লাগানো হয় প্রতিবার।
নিফান ভাবলো বড়রা কি বোঝে না গাছ আমাদের বন্ধু! গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়, ছায়া দেয়, বৃষ্টিকে ডেকে আনে এসব তো সবাই জানে। তা ও সবাই গাছ কেটে ফেলে কেন? ছোটোবেলায় যখন ওরা বাঙুরে ভাড়া থাকত,তখন ঐ বড় রাস্তাটার ওপর অনেক বড় বড় গাছ ছিল। পকুরের ধার দিয়ে ওর বাবা যখন ওকে নিয়ে বড়বাজারে যেত ছোট্ট ঈশান অবাক হয়ে বড় বড় গাছগুলোকে দেখত।
পুরো রাস্তাটায় ছিল ছায়া। আমরা যখন ক্লাস টু-তে পড়তাম, তখন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতাম একটা একটা করে সব গাছ কাটা হচ্ছে। ওর বাবা বলেছিল গাড়ির সংখ্যা এত বেড়ে গেছে তাই রাস্তা চওড়া হবে বলে ওরা গাছ কাটছে। রোদে খুব কষ্ট হ’ত আমাদের তখন গাড়িতে বসে থাকতে। এখন নিফান ক্লাস ১০এ পড়ে, কিন্তু ঐ রোড চওড়া হলেও আর গাছ লাগায়নি কেউ। কিছু ছোট গাছ লাগিয়ে পার্ক বানানো হয়েছে অবশ্য।
ওদের স্কুল থেকে এবার প্রসেশন হবে শহরের রাস্তায়। সবাইকে ২ টি করে চারাগাছ দেবে ওরা। অনেক লোক নিশ্চয়ই লাগাবে সেই গাছ।
কিন্তু নিফান ভাবে কয়জন লোক লাগাবে? ওর বন্ধু সিয়াম, ইয়াছিন, নিলয় এরা বাড়িতে থাকে বলে গাছ লাগিয়েছিল। আর বাকিদের গাছ লাগানোর জায়গা ছিল না। সবার গাছ মরে গিয়েছিল।
নিফানের ছোট মামা থাকে চট্টগ্রামে। মামার ছাদ জুড়ে বাহারি গাছের মেলা। বড় বড় গাছকে ওষুধ দিয়ে মামা ছোটো ছোটো টবে ধরে রেখেছেন। ছোট্ট ছোট্ট বট গাছের ঝুরি নেমেছে কোথাও, কোনও গাছ টবেই ফল দিচ্ছে।
কিন্তু ঐ গাছগুলো দেখলে নিফানে
খুব মন খারাপ হয়। ওদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে এভাবে আটকে ফেললে ওদের বুঝি কষ্ট হয় না!! ঈশান জানে গাছের ও প্রাণ আছে। ওরা কথা বলতে পারে না বলে মামা ওদের উপর এমন অত্যাচার চালাতে পারে! মামাবাড়ি নিফান এখন আর ছাদে ওঠে না। ওর মনে হয় গাছগুলো কাঁদছে। শুধু নিফান-ই শুনতে পায় গাছগুলোর কান্না।
খালার বাড়ি ফরিদপুর যেতে নিফান ভালোবাসে। খালার বাড়ি গ্ৰামে। চারদিকে অনেক গাছ। সবুজ আর সবুজ চারপাশ। পুকুরের পানি ও সবুজ। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয় নিফান ওখানে গেলে। কত রকমের ফল হয় খালার বাড়িতে। বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যখন বাতাস যায় শনশন আওয়াজ হয়। সন্ধেবেলায় খালার ঘরে বসে ঐ অন্ধকার বাঁশঝাড়ের গান শুনে ও নারকেল দিয়ে গরম মুড়ি খায় আর খালার মুখে গল্প শোনে। আগে খালা ওকে রূপকথার গল্প বলত। এখন বলে স্বাধীনতা সংগ্ৰামীদের গল্প।কিছু কিছু গল্প মুখে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে নিফানের।
সেদিন স্কুলে গিয়ে নিফান দেখল আনেক চারাগাছ এসেছে নার্সারি থেকে। দু’দিন পর সোমবার ওদের প্রসেশন সপ্তাহ উপলক্ষেব হ’বে অরণ্য সপ্তাহ। আরও অনেক গাছ আসবে স্যার বলেছিলেন। নিফানের মনটা আবার ও খারাপ হয়ে যায়। এই কয়েক হাজার গাছের ভেতর কয়েক’শ গাছও যদি বাঁচানো যেত!! স্কুলেও গাছ লাগানোর জায়গা নেই। রাস্তার লোকেদের কিছু গাছ দেওয়া হবে স্যার বলেছেন। মামাবাড়ির গাছগুলোর মত এই চারা গাছগুলোর কান্না শুনতে পাচ্ছিল নিফান। ওরা যে বাঁচতে চাইছিল। মন খারাপ নিয়ে ও বাড়ি ফেরে।
কিন্তু বাড়ি ঢুকেই দেখলো খালা এসেছে গ্ৰাম থেকে। আনন্দ হলেও ওর মুখ দেখে ওর খালা বলে, -''নিফানের মুখ এত কালো কেন? স্কুলে কিছু হয়েছে নাকি?''
খালা কে জড়িয়ে ধরে নিফান। খুলে বললো ওর দুঃখের কথা। ওর যে গাছ লাগানোর উপায় নেই।
হাত পা ধুয়ে খেয়ে নিয়ে ও বারান্দায় এসে বসে খালার কাছে গল্পের আশায়।
খালা বলে, -''আজ তোমায় একটা সত্যি গল্প বলব নিফান। তুমি যে গাছ ভালোবাসো তেমনি গাছ ভালোবাসে অনেকেই। আমাদের গ্ৰামের এক মাস্টার আছে। ফাঁকা জায়গা পেলেই গাছ লাগাতেন। লোকে তাকে গাছ-পাগল বলত। সরকার থেকে সে পুরস্কার পেয়েছিলেন সবুজ অভিযানের জন্য। তবে শহরে সত্যিই জায়গার অনেক অভাব।
এক গ্ৰামে এক চাষি থাকত তার বৌ নিয়ে। ওদের কোনো ছেলে মেয়ে ছিল না। এই নিয়ে গ্ৰামের সবাই ওদের হেয় করত। ঐ গ্ৰাম থেকে শহরে যাওয়ার পথটা ছিল অনেক রুক্ষ, বড় গাছ ছিল না তেমন। গরমের সময় ঐ পথ দিয়ে শহরে যেতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যেত। চাষির বৌ বেশ কিছু চারা গাছ নিয়ে ঐ পথের ধারে ধারে লাগিয়ে দিয়েছিল। রোজ অনেকদূর থেকে পানি বয়ে এনে গাছের পরিচর্যা করত ঐ বৌ। লোকে তাদের পাগল বলতে শুরু করল। তবুও তারা গাছের পেছনে পড়ে থাকল। অনেক দিনের চেষ্টায় কিছু গাছ বেঁচে গেল। বড় হয়ে উঠল তরতরিয়ে। ওরা আরও কিছু গাছ লাগালো। সব কাজ ছেড়ে ওরা এক সবুজের নেশায় মেতে উঠেছিল। কয়েক বছরের ভেতর পুরো পথটা ওরা গাছে ভরিয়ে দিল। সেই সব গাছ বড় হয়ে ছায়া দিল। পাখিরা এসে বাসা বাঁধলো। যে সব লোক আগে ওদের নিয়ে হাসাহাসি করতো তারাই এবার ধন্য ধন্য করে উঠল। ঐ চাষি পরিবার সন্তানস্নেহে গাছগুলোকে বড় করেছিল। পরে ওদের নামেই ঐ সড়কের নাম করন হয়েছিল।''
খালা থামতেই লাফিয়ে ওঠে নিফান, চোখ বড় বড় করে বলে, -''এটা তো থিমক্কার গল্প। আমি পড়েছি ক্লাস থ্রি তে। এটা কি সত্যি হয়েছিল ?''
-''হ্যাঁ নিফান, এটা সত্যি ঘটনা। গাছ লাগানোর জায়গা তোমায় খুঁজেতে হবে। একটা বড় গাছ যদি বাঁচে কত উপকার বলো তো?''
পরদিন স্কুল যাওয়ার পথেই নিফান খুঁজে নিয়েছিল গাছ লাগানোর জায়গা। অ্যাসেম্বলির পর ও নিজেই প্রিন্সিপালের কাছে যায় এবং খুলে বলে ওর পরিকল্পনা। প্রিন্সিপাল অবাক হয়ে দেখছিলেন ১৬ বছরের ছেলেটাকে। ওকে ক্লাসে যেতে বলে কয়েকটা দরকারী ফোন করেন উনি।
অরণ্য সপ্তাহের প্রোগ্ৰাম পরের দিন। সবাই সবুজ পোশাক পরে এসেছে। ওদের এবারের স্লোগান, "গো গ্ৰিন’'।
প্রসেশনের শুরুতে প্রিন্সিপাল দাড়িয়ে বললেন, - ''আজকে আমাদের অনুষ্ঠানে ছোট্ট একটা বদল এসেছে। আমরা শহরের রাস্তার বদলে বড়বাজারের ফাঁকা রাস্তায় যাবো । গাছ বিলি করার বদলে রাস্তার ধারে নিজেরাই গাছ লাগাবো। আমাদের স্কুলের বাইরে রাস্তার ধারে গাছ লাগিয়ে শুরু হবে আমাদের অভিযান। আর শুরু হবে ক্লাস ১০ এর নিফানএর হাত দিয়ে। কারণ এই সুন্দর প্রস্তাবটা ও-ই এনেছে। আমি সব পারমিশন নিয়েছি। এ বছর কাউকে গাছ দেবো না স্কুল থেকে। সব গাছ নিজেরাই লাগাবো। আর একেকটা ক্লাসের দায়িত্ব থাকবে এইসব গাছের পরিচর্যা করা। সোসাল ওয়ার্কের ভেতর থাকবে সেটা। গাছ শুধু লাগানো নয়, বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আমাদের।''
তুমুল হাততালির ভেতর নিফানকে নিয়ে এগিয়ে গেল বাইরের বড় রাস্তায়। ধু ধু প্রান্তরে ওদের স্কুল। রাস্তার দু’ধারে স্কুলের সবাই তখন ব্যস্ত গাছ লাগাতে। একঝাঁক সবুজ পোশাক পরা নানা বয়সী বাচ্চারা মনের সুখে পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলছে সবুজ রঙে।