অরুণাচল প্রদেশ ভারতের একটি রাজ্য। মূলত আসাম এবং নাগাল্যান্ড এর বর্ডারে অরুণাচল প্রদেশ অবস্থিত এবং আয়তনে প্রায় ৮৪০০০ বর্গ কিলোমিটার। অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা এই অরুণাচল প্রদেশ। এই রাজ্যে একই সাথে ভুটান, মায়ানমার এবং চীন এর বর্ডার আছে।
এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ থেকে একটা মেগা ট্রিপ দিয়েছিলাম একা একা।
ঢাকা - ডাউকি - শিলং - গোহাটি - অরুণাচল প্রদেশ - দিব্রুগারহ (আসাম) - কলকাতা - ঢাকা
মূলত একটি কনফারেন্স এর জন্য অরুণাচল প্রদেশ যাওয়া হলেও একজন ট্রাভেলার হিসেবে এই সুযোগটার সতব্যবহার করার চিন্তা প্রথম থেকেই ঘুরছিল। একদম পুরোদস্তুর সলো ট্রিপ ছিলো।
পুরো ট্রিপ টার বিস্তারিত ই অল্প অল্প করে লিখব কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ এর কথাটাই বেশি বলব এবং যারা যেতে চান তাদের জন্য কিছু তথ্য দেয়ার চেষ্ঠা করব।
২৮ তারিখ রাতে ঢাকা থেকে ডাউকি র উদ্দ্যেশে রওনা দেই এবং ২৯(!) তারিখ সকালে গিয়ে পৌঁছাই। সকালে হালকা নাস্তা করে সিলেট শহর থেকে একটি লোকাল বাস এ উঠে তামাবিল এর উদ্দ্যেশ্যে রওনা হলাম। ১-১.৫ ঘণ্টার ভিতর পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেখানে ট্রাভেল ট্যাক্স দিয়ে বর্ডার cek ইন পর হয়েই ঢুকে পড়লাম ভারতে। ডাউকি থেকে শিলং যাবার অনেক ট্যাক্সি পাওয়া যাবে , একটু দামদর করে ঠিক করে নিতে হবে। আমি মাঝখানে কিছু স্পট ঘুরে নিয়ে তারপর শিলং পৌঁছাই। মাউনি লং, লিভিং রুট ব্রিজ এবং আরো কিছু ভিউ পয়েন্ট এ গিয়েছিলাম। মাঝখানে এক জায়গায় নেমে দুপুরের খাবার টা খেয়ে নিয়েছিলাম। দুপুর 3 টা নাগাদ শিলং গিয়ে পৌঁছাই। মনে রাখবেন শিলং এ মোবাইল সিম পাওয়া টা একটু কষ্ঠের ব্যাপার, কলকাতার মতন সহজ না। দোকানদার রা বিক্রি করতে চায় না। আমি একটু হতে পায়ে ধরে একটা সিম এর ব্যবস্থা করেছিলাম। সাথে আমার ট্যাক্সি ড্রাইভার ভাই ও ছিলেন, উনিও সহায়তা করেন। এর পর হোটেল এ চেক ইন করে শিলং বাজার এ ঘুরলাম, আমার আবার মিষ্টি ভয়নকর রকম পছন্দ। দিল্লি মিষ্টান্ন বিতান থেকে ভরপুর মিষ্টি খেলাম আরো কিছু স্ট্রিট ফুড খেলাম। ওইদিন আর তেমন কিছু করা হয় নি। আমার শর্ট ট্রিপ ছিলো শিলং এ। শিলং বাজার আর গলফ কোর্স থেকে একটু ঘুরে এসেছিলাম শুধু। এর পর দিন খুব ভোর বেলা উঠলাম, লাইটলুম এ যাবো। হোটেল এর লবি তে যেয়ে খুব সুন্দর একটা ভিউ দেখি, জানালা দিয়ে সুন্দর রোদ এর আলো আসছে। বাইরে গাড়ি ঘোড়া নেই। হঠাৎ হোটেল ম্যানেজার এসে বলল
- ভাই বাইরে যায়েন না এখন।
- কেনো?
- কালকে রাতে খাসি আদিবাসী দের সাথে পুলিশ এর মারামারিতে ২ জন মারা গেছে, পুরা শিলং এ এখন কারফিউ।
আমার মাথায় পুরা হাত। বিশাল এক ঝামেলায় পরে গেলাম। যাক এরপর রুম এ গেলাম, কিছুক্ষণ শুয়ে বসে থেকে ৭.৩০ এ আবার বের হলাম। মনে মনে চিন্তা করলাম, নাহ! বাইরে যাবই। চলে গেলাম বাইরে, রাস্তা ঘাটে তেমন মানুষ ছিলো না কিন্তু যোখন ই নিউ মার্কেট মোড়ে গেলাম, গিয়ে দেখি অনেক ট্যাক্সি দাড়িয়ে আছে। একজন কে বললাম কারফিউ তে আপনারা বাইরে কি করেন? বলে যে এটা তো নিয়মিত ঘটনা, কয়েকদিন পর পর ই হয়। একটু অভয় পেলাম। বললাম যে লাইটলুম যাবো। উঠে পরলাম ট্যাক্সি তে। প্রায় ১ ঘণ্টার মতন সময় লেগেছিল। যখন গিয়ে পৌঁছলাম একজন মানুষ ও ছিলো না এবং এত সুন্দর ভিউ আমি এর আগে সত্যিই দেখি নি। অসম্ভব পছন্দের জায়গা হতে গিয়েছিলো এই লাইটলুম। কিছুক্ষণ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে শিলং চলে আসলাম। ইচ্ছা ছিলো বিকালে গোহাটির দিকে রওনা হব, কিন্তু কারফিউ দেখে সকাল ১১ টায় জিপ চেপে চললাম গোহাটির রাস্তায়। শিলং নিউ মার্কেট মোড় থেকেই জিপ পাওয়া যায়। গোহাটি পৌঁছাতে ৩ ঘণ্টার মতন সময় লাগবে। রাস্তায় মাঝে ১ বার ব্রেক দিবে দুপুরে খাওয়া র জন্য। দুপুর ৩ টায় গিয়ে গোহাটি পৌঁছাই। গোহাটি থেকে অরুণাচল প্রদেশ এর ট্রেইন রাত ১০টায়। এর মঝখানের সময় টা গোহাটির কিছু জায়গায় ঘোরাফেরা করলাম। ব্যাগ রাখার জন্য ট্রেইন স্টেশন এ লকার ভাড়া নেয়া যায়। ব্যাগ গুলো ওখানে রেখে ঘোরাফেরা শুরু করি। কম সময়ে কাছাকাছি কিছু জায়গায় ঘুরে ফিরে আসি। দ্রুত যাতায়াত এর জন্য উবার মটো ব্যবহার করি। অনেক কম খরচে অনেক জায়গায় ঘুরে যায়। পরিশেষে রাত ১০টায় ট্রেনে চেপে বসলাম দীর্ঘ প্রতীক্ষার অরুণাচল প্রদেশ এর উদ্দ্যেশ্যে। এখন অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে কথা বলব শুধু।
প্রথমেই বলে নিচ্ছি, অরুণাচল প্রদেশ একটি নিষিদ্ধ রাজ্য। এখানে যে কেউ চাইলেই প্রবেশ করতে পারবে না। আপনার উপযুক্ত কারণ দরকার হবে যাবার জন্য যেমন আমি গিয়েছিলাম কনফারেন্স এর জন্য। অরুণাচল প্রদেশ এ প্রবেশের জন্য আপনার যেই জিনিস টি দরকার হবে সেটি হচ্ছে "Inner Line Permit (ILP)"। আমি যেই ইউনিভার্সিটি তে গিয়েছিলাম কনফারেন্স এ, আমার ILP উনারাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। লিগ্যাল ভাবে যদি আপনি আপনি যেতে চান একটু কাঠখড় পুরতে হবে কিন্তু মজার কথা হলো, আপনি গোহাটি থেকে চাইলেই ILP ব্যবস্থা করতে পারবেন। সেখানে স্টেশন এর কাছে যেই কোন বাস বা ট্রেন এর কাউন্টারে গিয়ে বললে ওরা আপনাকে ব্যবস্থা করে দিবে।
তো রাত ১০ টায় রওনা দিয়ে ভোর ৫.৩০ এ গিয়ে নেমেছিলাম নাহারলাগুন রেইল স্টেশন, ওখান থেকে গন্তব্য ছিলো ইটানগর , যেটি হচ্ছে অরুণাচল প্রদেশ এর রাজধানী। নামার পর ই স্টেশন থেকে বের হবার সময় ILP টা চেক করে। সুতরাং, ILP কিন্তু নামমাত্র কিছু না, এর কাজ ও আছে। স্টেশন থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম পাহাড়ে ঘেঁরা চারপাশ। অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য ছিল। অরুণাচল প্রদেশ এর মূল বহন হচ্ছে টাটা সুমো, প্রাইভেট কর আর সি এন জি।
এলার্ট !! এলার্ট !! এলার্ট !!
মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকুন আগে থেকেই, অরুণাচল প্রদেশের যাতায়াত খরচ একদম গলাকাটা। রেইলস্টেশন থেকে ইটানগড় এর দূরত্ব প্রায় ১৩ কি.মি। আইডিয়া ডেয়ার জন্য বলছি, দূরত্ব টা হচ্ছে মালিবাগ থেকে কুড়িল বিশ্ব রোড পর্যন্ত। স্টেশন এ সচরাচর ট্যাক্সি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। আমি ভাড়া জিজ্ঞেস করলাম, বলল 1800 রুপি। আমার মাথায় হাত পড়া ছাড়া আর কি করা আছে ভাই? শেষ পর্যন্ত 1500 রুপি বলেছিলো, সেটাও তো মাত্রাতিরিক্ত !! দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন মানুষ নেই কোন গাড়ি ঘোড়া নেই। হতাশ হতে দাড়িয়ে ছিলাম। কথা থেকে যেনো একটা সি এন জি আসলো। অনেক কষ্ঠে রাজি করলাম যাওয়ার জন্য। বলল 500 রুপি নিবে কিন্তু রাস্তায় অন্য কাউকে পেলে নিবে শেয়ার করতে হবে। উপায় না পেয়ে উঠে পরলাম। আশা ঘণ্টার মতন লাগল যেতে। ইটানাগার এর রাস্তা খুব খারাপ , পাহাড় এর উপর দিয়ে রাস্তা, অনেক ভাঙ্গা রাস্তা। সি এন জি থেকে নেমে একটি হোটেল এ উঠলাম। আমার প্ল্যান টা ছিলো এমন,
৩ দিন থাকবো অরুণাচল, প্রথম দুই দিন আমার কনফারেন্স এ প্রেজেন্টেশন, তাই ঐ দুই দিন কিছু করার ছিলো না আশে পাশে ঘুরাঘুরি করা ছাড়া। ইটাফোর্ট, একটা পার্ক এগুলাই আছে ওখানে। কিন্তু ওখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ টাই অন্যরকম। হোটেল এর জানালা থেকে ভোর বেলা কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়। আমি শেষদিন টা রেখেছিলাম জিরো তে যাবার জন্য। তৃতীয় দিন একদম ভোর বেলা সুমো কাউন্টার এ চলে গেলাম পায়ে হেটে। ১৫-২০ মিনিট হাটা লেগেছিলো। সুমো দিয়ে জিরো তে যেতে প্রায় ৫ ঘন্টার মতন লেগে যায়। জিরো অসম্ভব সুন্দর একটি যায়গা, চারপাশে পাহার আর সবুজে ঘেরা। ভালো খাবার হোটেল খুজে পাওয়া টা অরুনাচল প্রদেশ এ একটু কষ্ঠ। ইটানগরে আমি ডমিনোস পেয়েছিলাম, ওখানে খেয়েছিলাম আর জিরো তে একটা লোকাল হোটেল এ খাওয়া দাওয়া করেছিলাম। জিরো তে দুইটা যায়গায় গিয়েছিলাম, "কিলে পাখো" এবং "টালে ভ্যালি"। জিরো তে হোটেল এর খরচ টা একটু বেশী। আমি এক রাত থাকতে আমার প্রায় ১২০০ রুপি গুনতে হয়েছিলো এবং হোটেল টা একদম নরমাল ছিলো। তবে আপনারা যদি কেউ অরুনাচল প্রদেশ যাওয়ার কথা চিন্তা করেন, মনে রাখবেন, অরুনাচল প্রদেশ এর সবচাইতে সুন্দর হচ্ছে তাওয়াং। আমি হলফ করে বলতে পারি, তাওয়াং এর সুন্দর্য আপনাদের সবাইকে মুগ্ধ করবে। আমি সময়ের অভাবে যেতে পারি নাই। তাওয়াং যেতে হলে আপনাকে নুন্যতম ৫ দিনের প্ল্যান করতে হবে। ইটানগর থেকে তাওয়াং যেতে প্রায় ১৪ ঘন্টা সময় লাগে। তাওয়াং এ প্রায় ৪০০ বছর পুরানো একটি মনস্টেরি আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফিট উপরে তাওয়াং। বুঝতেই পারছেন এটার সুন্দর্য কেমন হতে পারে। তাওয়াং এ একটা যায়গা আছে পাহার এর উপর, যেখান থেকে একি সাথে ভুটান এবং চায়নার বর্ডার দেখা যায়। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো তাওয়াং যাবার। ইনশাল্লাহ যদি আবার কখনো যাওয়া হয় অবশ্যই যাবো। আমি শুধু দেখার সুবিদার্থে আপনাদের জন্য তাওয়াং এর একটি ছবি দিয়েছি গুগল থেকে নিয়ে। যাতে আপনারা একটু আইডিয়া নিতে পারেন তাওয়াং এর সৌন্দর্য এর ব্যাপারে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জিরো থেকে দিব্রুগারহ(আসাম) এর উদ্দ্যেশ্যে রউনা হলাম, প্রায় ৪ ঘন্টার যাত্রা। দিব্রুগারহ থেকে কলকাতা চলে আসি। কলকাতায় খুব বাজে কিছু এক্সপেরিয়েন্স এর সম্মুক্ষিন হয়েছিলাম। কষ্ঠের সাথে বলতে হচ্ছে, কলকাতার মানুষদের সাথে খুব বুঝে শুনে চলা উচিত। তাদের ভিতর ঠকানোর চিন্তাধারা অনেক বেশি। কলকাতায় ২ দিন থেকেছিলাম। কলকাতার ব্যাপারে আর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু কলকাতায় খাবার দাবার খুব ভালো আর ঘুরাফেরার জন্য হাউরা ব্রিজ যেতে পারেন। ২ দিন থেকে এর পর চলে আসা বাংলাদেশে।
আমি খুব একটা ছবি তুলি না, তাই সব ভিউ এর ছবি তুলতে পারি নাই। যতগুলো তুলেছি সেগুলো দিয়ে দিলাম।
লিখাটিতে বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কারো যদি অরুনাচল যাবার ব্যাপারে কোন সাহায্যের দরকার হয় জানাবেন আমাকে, আমি চেষ্টা করব যতটুকু পারি সাহায্য করার।
খরচ এর বিস্তারিতঃ
ঢাকা - সিলেটঃ বাসঃ ৪৭০ টাকা (বাস)
সিলেট- তামাবিলঃ ৮০ টাকা (বাস)
ডাউকি - শিলংঃ ১৭০০ রুপি ( ট্যাক্সি, অনেক গুলো স্পট এ ঘুরে গিয়েছিলাম, তাই একটু বেশি খরচ হয়েছে)
শিলং হোটেল ভাড়াঃ ৮০০ রুপি
শিলং-লাইটলুম-শিলংঃ ৫০০ রুপি (ট্যাক্সি)
শিলং-গোহাটিঃ ২০০ রুপি (সুমো)
গোহাটি-নাহারলাগুনঃ ৬০০ রুপি (ট্রেইন)
নাহারলাগুন-ইটানগরঃ ৫০০ রুপি (অটো)
ইটানগর হোটেল ভাড়াঃ ৩০০০ রুপি ৩ রাত
ইটানগর-জিরোঃ ১২০০ রুপি (সুমো)
জিরো হোটেল ভাড়াঃ ১২০০ রুপি
জিরো-দিব্রুগারহঃ ১৫০০ রুপি (সুমো)
হ্যাপি ট্রাভেলিং