সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতায় বলেছেন-
‘পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এদেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।’
আজকের তরুণরাই আগামী দিনের দেশ ও জাতির কর্ণধার। তরুণ অর্থাৎ যুবসমাজই পারে শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে দেশকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যুবসমাজ এখন বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণে জাতি হতাশায় নিমজ্জিত। যুবসমাজের অবক্ষয় জাতির বুকে গভীর ক্ষত তৈরি করছে। গোটা সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে। আর এই সমস্যার প্রতিকার না হলে দেশ ও জাতি ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হবে।
অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ক্ষয়প্রাপ্তি। মানবজীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে হলে কিছু গুণের প্রয়োজন হয়। আর মানুষের এই গুণগুলি যখনই লোপ পায় বা নষ্ট হয় তখনই শুরু হয় নৈতিক অবক্ষয়। কোনো একটি দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হলো যুবসমাজ। তারা কখনও পরাজয় মেনে নেয় না এবং পুরাতনকে নতুন করে গড়তে চায়। কিন্তু এই যুবসমাজ যখন খারাপ পথে ধাবিত হয় তখন সমাজের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা যায়। যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণে জাতীয় জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখ-দুর্দশা, বিপর্যয় ও হতাশা।
আমাদের দেশের যুবসমাজ আজ নানা ধরণের নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে। নিম্নে যুব সমাজের অবক্ষয়ের প্রধান কারণগুলো বর্ণনা করা হলো-
১৯৭১ সালে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে আমাদের দেশে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে নানা ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এখনও বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশের রাজনীতি ধীরে ধীরে পেশিশক্তি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন বিপথগামী তরুণদের ব্যবহার করছে। আবার বিপথগামী তরুণরা কেন্দ্রীয় এবং জাতীয় নেতাদের প্রশ্রয় পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে যায়। দুর্বল অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থাও যুব সমাজের অবক্ষয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী। আমাদের সমাজের অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে লেখাপড়া করতে পারে না। এতে তারা শিক্ষার অভাবে নানা কুসংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন হয় এবং বিপথে ধাবিত হয়। তাই অর্থনৈতিক অভাবের কারণে যুবসমাজ তাদের নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
জীবনে সৎ, সুন্দর, কল্যাণকর ও শান্তির মাধ্যমে বেঁচে থাকতে হলে কতগুলো গুণের প্রয়োজন হয়। আর এই সব গুণকেই সাধারণত মূল্যবোধ বলা হয়। সামাজিক ও ধর্মীয় এসব মূল্যবোধ যুবসমাজকে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের দিকে পরিচালিত করে। বর্তমান সমাজে এ সকল মূল্যবোধের অনুশীলন ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। ফলে যুবসমাজ বিপদগামী হচ্ছে।
আমাদের দেশের যেসব তরুণ-তরুণী লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পায় না তারা নানা রকম মানসিক হতাশায় ভোগে। চাকরির অভাবে তারা অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দীর্ঘ সময় এই অবস্থা চলতে থাকলে তাদের ভেতরে ক্ষোভ জন্ম নেয়। আর এই ক্ষোভ থেকেই তারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা ও অপহরণসহ নানা পাপ কাজে লিপ্ত হয়। আবার কোনো দেশের যুব সম্প্রদায় মাদকাসক্ত হওয়া মানে নৈতিক চরিত্রের চূড়ান্ত অধঃপতন। ফেনসিডিল, গাঁজা, আফিম, ভাং ইত্যাদি মাদকদ্রব্য সর্বত্র পাওয়া যায়। আর এ সুযোগ গ্রহণ করে যুবসমাজ ধ্বংস হচ্ছে।
আমাদের সমাজের তরুণদের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হলো বিদেশি সংস্কৃতির নামে এক ধরণের অপসংস্কৃতির প্রসার। বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্রের অশ্লীল নাচ, গান, সংলাপ যুবসমাজকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে ফেলছে। ডিশ এন্টেনার প্রভাবে বিদেশি অপসংস্কৃতি আমাদের যুবসমাজকে চেপে ধরেছে। তাছাড়া রুচিহীন পোশাক-পরিচ্ছদও অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা ও বিশৃংখলা অনেক সময় ছাত্র-ছাত্রীদের বিপথে পরিচালিত করে। ভর্তির সমস্যা, পরীক্ষা পিছিয়ে নেওয়া, ফল প্রকাশের বিলম্ব, সেশনজট এবং যখন তখন ধর্মঘট ইত্যাদি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাছাড়া যে সব প্রতিষ্ঠানে বোমাবাজি, ককটেলবাজি এবং মারামারি লেগেই থাকে সেসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের মনে সব সময় ভয়-ভীতি কাজ করে। আবার কখনও দেখা যায় যে, গুটিকয়েক সন্ত্রাসী সমস্ত ছাত্র সমাজকে জিম্মি করে রাখে।
কোনো দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে যুবসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই যুবসমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিম্নে যুব সমাজের অবক্ষয়ের কিছু প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
প্রতিটি মানুষই কোনো একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। শিশুকাল থেকে সে পরিবারেই বেড়ে উঠে। তারপর সে ধীরে ধীরে সমাজের সাথে পরিচিত হয়। শিশুদের মন শৈশবকালে কাদার মতো নরম থাকে। এই সময় তাদের ইচ্ছা মতো গড়ে তোলা যায়। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারই পারে তাদের সন্তানদের উপযুক্ত মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে।
আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সুন্দরভাবে জীবনযাপনের অন্যতম শর্ত হলো শিক্ষা। তাই যুবসমাজকে অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষিত করা প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া উচিত। আবার যে সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে সেগুলো সমাধান করা উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার উপযুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে সেশনজট নিরসন এবং উপযুক্ত সময়ে একাডেমি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পরীক্ষা নিতে হবে। এতে যুবসমাজের অবক্ষয় রোধ হবে।
আমাদের দেশের অনেক যুবকই বেকার। তাদের উৎপাদনশীল কাজে জড়িত করতে পারলে বেকারত্ব হ্রাস পাবে। আর বেকারত্ব হ্রাস পেলেই যুব সমাজের অবক্ষয়ও কমে যাবে। আবার যুব সমাজের অবক্ষয় থেকে মুক্তি লাভ করতে দরিদ্রতা দূর করতে হবে। দরিদ্র যুবকদের বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীল করে তোলার জন্য সরকারকে বিনা সুদে ঋণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
ধর্মীয় মূল্যবোধই পারে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে। যুব সমাজের বিরাট একটা অংশ ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে আছে। তাই যুবসমাজকে অবক্ষয় থেকে মুক্তির জন্য ধর্মীয় শিক্ষা অপরিহার্য।
যুব সমাজের অবক্ষয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে অপসংস্কৃতি। যুবসমাজের বিশাল অংশ এখন বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি ধাবিত হচ্ছে। এতে করে তাদের রুচি বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষামূলক এবং সপরিবারে দেখার মতো চ্যানেলগুলো রেখে বাকি চ্যানেলগুলো বন্ধ করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে, নিজেদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হতে হবে।
অবক্ষয়কে একটি ভয়াবহ ব্যাধি বলা যায়। বর্তমানে এই ব্যাধি যুবসমাজকে গ্রাস করে ফেলছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। তাই যুবসমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত। যুবসমাজ সচেতন হলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব হবে।