সিন্থেটিক লাইফ

in blurt •  3 years ago 

সিন্থেটিক লাইফ
১.
লাইফ, জীবন, প্রাণ। একজন সাধারণ মানুষকে এই শব্দগুলো হয়তো বিশেষ ভাবায় না। কিন্তু একজন জীববিজ্ঞানী বা জীববিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে এমন কারও কাছে লাইফ খুবই আকর্ষণীয় একটা শব্দ। আমি এস্ট্রোবায়োলজি নিয়ে স্টাডি করছি। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এস্ট্রোবায়োলজি হলো বহির্জাগতিক বায়োলজি অর্থাৎ পৃথিবীর বাইরে জীবনবিদ্যা সম্পর্কিত বিষয়। আমরা যখন পৃথিবীর বাইরে জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলতে চাই, তখন সবার প্রথমে জীবনকে একটা ভালো সংজ্ঞা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কোনো কিছু সন্ধান করার আগে ঠিক কি জিনিস আমরা সন্ধান করছি সেটা পরিষ্কার করে তারপর এগোতে হয়। সিম্পলি যদি এককোষী জীবের কথা চিন্তা করি, একটা কোষ সিস্টেম হিসেবে যতটা না জটিল, গাঠনিক দিক দিয়ে তার চেয়ে অনেক অনেক সরল। এবং জীব যত নিম্ন শ্রেণির দিকে যায়, ততই জড় বৈশিষ্ট্য বাড়তে থাকে। এজন্য জীব এবং জড় এর মধ্যে একটা লাইন টেনে আলাদা করা একটা পর্যায়ে যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়ে। প্রযুক্তির উন্নয়ন হচ্ছে, টেকনোলোজি এমন কিছু নিয়ে আসছে যেটা ভবিষ্যতে জীবনের সংজ্ঞার জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সিন্থেটিক লাইফ বা আর্টিফিশিয়াল লাইফ এগুলো খুব দ্রুতই আমাদের দিকে প্রশ্ন নিয়ে হাজির হবে, আমরা কাকে লাইফ বলব? আর কাকে বলব না?
২.
আজকের বিষয় ইঞ্জিনিয়ারিং বায়োলজি নিয়ে। আশেপাশে দেখা অদেখা সকল জীবই কোষ দিয়ে গঠিত। কোষ আবার বিভিন্ন অঙ্গাণু নিয়ে গঠিত, কোনটা কি কাজ করে, কি দিয়ে গঠিত এগুলো আমরা সবাই জানি। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অর্জন করা আমাদের জীবন বিষয়ক জ্ঞান এখনও পরিপূর্ণ নয়। আমরা এখনও একশত ভাগ জানি না কীভাবে একটা কোষ কাজ করে। হ্যাঁ আমরা অবশ্যই অনেকখানি জানি, কিন্তু এখনও অনেক অজানা বিষয় রয়েই গেছে। আগেই তো বললাম সিস্টেম হিসেবে একটা কোষ বেশ জটিল। আমরা জিনোম সিকোয়েন্সিং করে অনেক প্রোটিনের ব্যাপারে জেনেছি। কিন্তু এখনও প্রত্যেকটা জিনোম, প্রত্যেকটা প্রোটিন কীভাবে কাজ করে তা জানি না। এখনও কোষের কোনো কমপ্লিট কেমিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট লিস্ট নেই। এসব কারণে বায়োলজি স্টাডি বা মডিফাই করা এখনও কঠিন, বিষয়টা এরকম যে একটা ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করছি কিন্তু তার ব্লুপ্রিন্টই নেই। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য নিয়ে সবারই কম বেশি ধারণা আছে। এখন পর্যন্ত আমাদের জানা যত জীব আছে তাদের প্রত্যেকে একইভাবে কাজ করে। পৃথিবীতে একটি মাত্র লাইফ ফর্ম আছে। একটা লাইফ ফর্ম মানে একই রকমের বায়োলজি। সব জীবের বায়োকেমিস্ট্রি একই রকম। যদিও একটাই মাত্র লাইফ ফর্ম, তার পরেও আমরা সেটার পুরোপুরি জানি না, কারণ এটা যথেষ্ট রকমের জটিল। জটিল জিনিস বোঝার উপায় হচ্ছে তাকে সরল করা। সরলীকরণ। এটাই সিন্থেটিক সেল ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্ম দিয়েছে। একটা ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে সেটা বোঝার জন্য ইঞ্জিনিয়াররা কি করে? ইঞ্জিনকে খুলে টুকরো টুকরো করে, তারপর নিজে আবার বানিয়ে দেখে। বায়োলজিক্যাল সিস্টেমের ক্ষেত্রে কি এমনটা করা যায়? হ্যাঁ যায়। লাইফকে বোঝার জন্য লাইফ ক্রিয়েট করে দেখা। এবং এটা করে দেখা শুরু হয়েগেছে। একটা কোষের বিভিন্ন অংশকে আমরা আলাদা আলাদা ভাবে তৈরি করতে পারি, এবং সেগুলোকে নিজেদের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করে দেখতে পারি। Make it yourself, so you know how it’s made..
৩.
সিন্থেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কেন দরকারি? এর উত্তরে বলা যায় বায়োলজিক্যাল রিসার্চ কেন দরকারি? বায়োলজিক্যাল রিসার্চের নতুন দিগন্ত হলো এই সিন্থেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। আমরা জীবন সম্পর্কে জানতে চাই, বুঝতে চাই আরও গভীরভাবে। নতুন বায়োলজিক্যাল স্ট্রাকচার তৈরি করতে চাই, আরও উন্নত ড্রাগ বানাতে চাই। মহাবিশ্বে জীবনের অস্তিত্ব, এর ইতিহাস সম্পর্কে আমরা জানতে চাই। এবং একদিন জীবনকে ছড়িয়ে দিতে চাই দূর প্রান্তে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই আর্টিফিশিয়াল কোষ ন্যাচারাল কোষের চেয়ে বেশি সুবিধা দেয়। ন্যাচারাল কোষ নিয়ে গবেষণা করা সময় সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং কঠিন। সিন্থেটিক সেল অবশ্যই সাশ্রয়ী এবং কাজ করা সহজ। সিন্থেটিক সেল নিয়ে বায়ো-সেফটি বা বায়ো-কন্টেইনমেন্টের চিন্তা করতে হয় না, যেকোনো এক্সপেরিমেন্ট স্বল্প সময়ের মধ্যে করা সম্ভব। কারণ এ কোষগুলো তৈরি করা, কবে গ্রো করবে তার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে না। ন্যাচারাল সেল থেকে যে কম্পাউন্ডগুলো তৈরি করা খুবই কঠিন বা প্রায় অসম্ভব সিন্থেটিক সেল থেকে সেগুলো তৈরি করা যাবে খুব সহজেই। এর ব্যবহার ড্রাগ তৈরি থেকে শুরু করে কসমেটিক, পারফিউম পর্যন্ত হতে পারে। সিন্থেটিক সেলকে যেহেতু আমরা নিজেদের মতো করে মডিফাই করতে পারি তাই যেকোনো রোগের চিকিৎসা এবং রোগ সম্পর্কে সহজেই জানতে পারি। এক কথায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যাপক উন্নতি সাধন হবে। এই আর্টিফিশিয়াল কোষগুলো আদি পৃথিবীতে জীবন কেমন ছিল তার সম্পর্কেও আমাদের হাজারও প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে। কেমন কন্ডিশনে কোনো গ্রহ প্রাণ ধারণের উপযোগী হবে সে ব্যাপারেও আমরা জানতে পারব। আর হয়তো একদিন আমরা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারব নিজেদের বায়োলজিকে, কাটিয়ে তুলতে পারব বহু প্রতিবন্ধকতা, হয়তো পাড়ি জমাতে সক্ষম হবো ব্রহ্মাণ্ডের দূর গ্রহগুলোতে, পৃথিবী ছাড়িয়ে মানব সভ্যতা ছড়িয়ে পড়বে গ্রহান্তরে, তারায় তারায়।

life.jpg

৪৭৩টা জিন নিয়ে তৈরি হয় মানব সৃষ্ট প্রথম সিন্থেটিক অরগানিজম। বেড়ে ওঠা আর বংশবৃদ্ধি করার সময় এটা অদ্ভুত আচরণ করে। অপত্য কোষগুলো অস্বাভাবিক আকার আকৃতি ধারণ করে। আকার আকৃতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ৭টি জিন খুঁজে বের করা হয়।
২০১০সালে সিন্থেটিক জিনোম দিয়ে শুরু হয়েছিল সিন্থেটিক সেলের প্রথম যাত্রা, JCVI-syn-1.0 নামক সেই কোষটি ছিল অর্ধেক সিন্থেটিক, অর্ধেক ন্যাচারাল। ছয় বছর আগে তৈরি হয় সুপার সিম্পল সেল JCVI-syn-3.0… সিন্থেটিক সেলের সবচেয়ে আধুনিক সংস্করণ JCVI-syn-3.A এতে আগের সমস্যাগুলো নেই। বেশ ভালোভাবেই বংশবৃদ্ধি হচ্ছে, আকার ও আকৃতি স্বাভাবিক কোষের মতো হচ্ছে। গবেষণা চলছে আরও নিখুঁত করার। প্রযুক্তি এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। একদিকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, অন্যদিকে সিন্থেটিক লাইফ। কিছুদিন পর কম্পিউটারে বসে সফটওয়্যার কোডিং করার মতো ঘরে বসে লাইফ কোডিং করা ডাল ভাতের মতো হয়ে যাবে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যখন জীবনের সংজ্ঞা দিয়ে গিয়ে আমাদেরকে এই আর্টিফিশিয়াল লাইফের কথা মাথায় রাখতে হবে। আমরা কাকে জীবন্ত বলব? আর কাকে বলব না?

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE BLURT!